।। বাক্ ১২৫ ।। আগামীকাল এইসব লিখেছিলাম ।। রিপন হালদার ।।













পর্ব : দ্বিতীয়






ও অথবা ব্ল্যাকহোলের ওংকার

   ই এম আই-তে কেনা এই ল্যাপটপটা বছর দুই চলছিল ভালোই এখনো ভালো চলছে একটু স্লো এই যা অবশ্য র্যাম বাড়িয়ে নিলে নাকি স্পিড বেড়ে যাবে এক বন্ধু বলেছিল
   যাই হোক, সমস্যা সেটা না কদিন ধরেই ও লক্ষ্য করছে ল্যাপটপের ডিসপ্লের উপরে বাঁ দিকে একটা ছোট মত কালো দাগ প্রায় গোল তবে পৃথিবীর মত অভিগত গোলক উত্তর দক্ষিণে একটু চাপা  
   এক সপ্তাহ আগেও এটা ছিল না গত পরশু থেকে এর আবির্ভাব পরশু ছিল একটা ছোট্ট বিন্দু আকৃতির আর আজ প্রায় একটা গোটা এক টাকার কয়েনের আকারে বেড়ে উঠেছে
   তিন দিনে এর পরিধি যে হারে বেড়েছে তাতে মনে হয় দিন পনের লাগবে পুরো স্ক্রিন কালো হয়ে যেতে
   তারপর ডিসপ্লে পালটানোর খরচ আগের টাকাই এখনো সব শোধ হয় নি তার উপর এটা ডিসপ্লের দাম পড়বে কম পক্ষে ছয় হাজার নেটে দেখেছে এই মুহূর্তে এত টাকা কোথায় পাবে ও!
   ওর আয় বলতে ছোট খাটো এডিটিং বিশেষ করে বিয়ে বাড়ির ভিডিও এডিট এখন বিয়ের অফ সিজেন ভরসা বলতে একটা শর্ট ফিল্ম সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারলে হাতে কিছু টাকা আসবে কিন্তু তাতেও কি ওর খরচ কুলোবে! ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, খাওয়া খরচ, ইন্টারনেট খরচও রাখতে হবে এইসব ভাবলেই ওর মাথা ব্যথা করে তাই ঠিক করেছে এসব নিয়ে আর ভাববে না চড়ে বসেছে ও সময়ের পিঠে দেখাই যাক, কোথায় নিয়ে যায়!
   শর্ট ফিল্মের গল্পটা ইন্টারেস্টিং কিন্তু প্রচুর শট অনেক কাটা ছেঁড়া করতে হবে প্রায় পাঁচ ঘন্টার ফুটেজ কেটে তিরিশ মিনিটের মধ্যে আনতে হবে এর কম সময়ে হলেও ভাল হয়। ডিরেক্টারের ইচ্ছা মাঝে মাঝেই এসে তিনি এটা ওটা ইন্সট্রাকশন দিয়ে যান জটিল কাজ তবে এসব কাজ ও ভালোই পারে এতে ও অনেকটা শল্য চিকিৎসা করার মত আনন্দ পায়নিজেকে খানিকটা স্রষ্টা স্রষ্টা মনে হয়     
   ল্যাপটপ ছাড়াও ওর ঘরে আরো কয়েকটা ছোট খাটো ডিভাইস রয়েছে যেমন- পুরনো একটা ক্যামেরা, দুই তিনটা কি-বোর্ড, ডাটা কেবলের জট পাকানো কিছু তার, লাইট কাটার প্রভৃতি সব কিছু ঘরের এদিকে ওদিকে ছড়ানো ছিটানো থাকেকখনোই গুছিয়ে রাখে নাএই বাহ্যিক  বিশৃঙ্খলাই নাকি ওর ভাবনার শৃঙ্খলাকে ঘন করে কেউ ঘরে প্রবেশ করলে সাবধানে এগুলোর উপর দিয়ে ডিঙিয়ে আসতে হয় যেন বিষাক্ত সাপের উপর দিয়ে চলা আর এই সাহসী অভিযান শেষে পদ যুগল মেঝেতে পাতা বিছানার উপর বিশ্রাম পায়না, খাট বা চৌকির এক পাও এখনো  এই ঘরে প্রবেশ করতে পারেনি     
   এই শহরে ও এসেছিল ফটোগ্রাফার হতে হয়ত পরে চলচ্চিত্র পরিচালক হবার আকাঙ্ক্ষাও সুপ্ত ডিমের মত লুকিয়ে ছিল হৃদয়ে তিরিশ বছরের জন্মদিন পার করেছে গত সোমবার      
   সেই রাতে এই ঘরে একা একা সস্তা বিয়ার খেতে খেতে ও ভাবছিল- ওর তো একটা কিছু হওয়ার ছিল        
   সেই বছর তিনেক আগে উত্তর বঙ্গ থেকে বেরিয়েছিল এই শহরের পথে। শুধু স্বপ্ন পুঁজি করে। বড় ফটোগ্রাফার হবে। ভেঙে দেবে সিনেমার গতানুগতিক সিরিয়াল মার্কা ফটো ফ্রেমনতুন  কিছু উদ্ভাবনী কৌশলও ও ভেবে রেখেছিলআলাপ জমানোর চেষ্টা করেছিল ফিল্ম স্টুডিওর কয়েকজনের সাথে। কিন্তু ওর মত আউটসাইডারের সাথে কথা বলতে কার সময় আছে !
  শেষে অনেক কষ্টে ‘সংসার সমগ্র’ ছবির পরিচালকের সাক্ষাৎ পেলও-র কাজের নমুনা দেখে তিনি তো বেজায় খুশি। ব্রেক দিয়ে ফেলেন আরকি। শেষে গিল্ড নামক জুজুর ভয়ে পিছু হটে  বলেন, ‘তোমার হবে। তবে লেগে থাকতে হবে।‘   
   সেই পাঁচ আঙুলে আংটি বাঁধানো লালচে হাতের ইশারা এখনো ও-কে ভরসা যোগাচ্ছে, ‘তোমার হবে...তোমার হবে।‘ কিন্তু কী যে হচ্ছে বা হবে এখনো পর্যন্ত ও বুঝতে পারছে না।    
   সাফল্যের মধ্যে বলতে গেলে কম ভাড়ায় শহরের এই প্রান্তিক অঞ্চলে মাথা গোঁজার এক ফালি ঘর ও যোগাড় করতে পেরেছে। প্রতি মাসের ঠিক এক তারিখে সকাল সাতটা নাগাদ জানলার আলো আড়াল করে এসে পড়ে বাড়িওয়ালার বিরাট কালো রোমশ হাত, ‘ভাড়াটা দাও !’     
   ভাড়ার জন্য উনি কখনো দরজার কাছে আসেন না বা ঘরের ভিতরেও ঢোকেন না। সমস্ত কারবার ওনার জানলা মারফৎ তবে জানলা বন্ধ থাকলে উনি ওনার বলবান হাত দ্বারা নিরলস বিস্ফোরণ সৃষ্টির মত জানলার কপাটে উপযুক্ত শব্দ উৎপাদনে সচেষ্ট থাকেন এবং অনতিবিলম্বে সাফল্যও লাভ করেন     
   টাকাটা কীভাবে যে ও ভিখারীর খুচরোর মত আগলে রাখে ও-ই জানে।     
   তাই বলে ওর জীবনে কোন আনন্দ বা এন্টারটেইনমেন্টের অস্তিত্ব নেই! আছে তো! সামান্য একটুউঁহু না বলা উচিত অসামান্য, অনেকটা রাত জেগে এডিটিং-এর পাশাপাশি চলে নেট ওয়ার্কিং সাইটে চ্যাট অথবা কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে কথা বলা ঘন্টার পর ঘন্টা এই রকম দুই তিনটি কাজ ও একই সময়ে দক্ষতার সঙ্গে করে চলে যাকে বলে মাল্টি টাস্কিং 
   ও কথা বলে কাদের সাথে? অবশ্যই মেয়েদের সাথে মেয়েদের সাথে না বলে বলা উচিত মেয়ে মহলের সাথে কত কত সাদা ধবধবে মুখ প্রতিদিন ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়! দুই তিন মাস থাকে তারপর কোথায় যেন তারা ভ্যানিশ! আবার আসে আবার ভ্যানিশ এভাবেই স্ক্রিন জুড়ে চলতে থাকে পি সি সরকারের যাদু      
   ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর কারণ এই নয় যে, ও দেখতে ভীষণ সুদর্শন বা ঐ জাতীয় কিছু মনে হয় ওর ফটোগ্রাফির আকর্ষণে সহৃদয় কন্যাগণ ওর দিকে ম্যাগনেটিক ওয়েভের মত ছুটে ছুটে আসেন আর আকর্ষণ ফুরিয়ে গেলে আবার সরেও পড়েন এই যাওয়া আর আসার মাঝখানে গড়ে ওঠা সরু সময়টুকু ও উপভোগ করে  
   কয়েক জনের ছবিও তুলে দিয়েছে মডেল প্রোফাইলের জন্য খুশিতে ডগমগ হয়ে তারা ওর গালে আর ভাগ্য অতি প্রসন্ন থাকলে ঠোঁটে দু-চার পিস্ ছোট লাল নৌকা এঁকে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত উঠে পড়েছে ট্যাক্সিতে      
#
   ওর ইনটুইশন বলছে খুব শীঘ্রই ওর জীবনে বড় একটা ব্রেক আসতে চলেছেযাকে বলে তীব্র ভাঙন এবং ও ভীষণ ভাবে তার জন্য অপেক্ষাও করছে যদিও তার কোন চিহ্ন বা আভাস এখনো পর্যন্ত ও দেখতে বা বুঝতে পারছে নাব্যাপারটা এমনই বিমূর্ত বায়বীয়       
   ওর বাবা মাঝে মাঝেই ফোনে ধমকান-‘বাড়ি চলে আয়জায়গা জমি দেখাশুনা কর্‌! ভালো না লাগলে বাজারে একটা দোকান দিয়ে দেব কম্পুটারের…’    
   ও যায় না আর বাড়ি থেকে কোন টাকা পাঠানোর আবদারও করে না। প্রায় তিন বছর ধরে ও  লেপ্টে আছে এই শহরে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ছোট বেলা থেকেই ওর ভিতরে একটা দুর্মর আকাঙ্ক্ষার শিকড় গেড়েছিল, কিছু একটা ওকে হতেই হবে যে ভাবেই হোক কিন্তু কীভাবে, ও জানত না অবশ্য এখনো জানে না এমন কিছু ও হতে চাইত যা কিনা অন্যদের থেকে আলাদা।
    ইলেকট্রনিক গেজেটপ্রিয় ও ভাবতেই পারেনি ক্যামেরা আর এডিটিং-এর এই মহানন্দময় জগত্‌টা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। উচ্চ মাধ্যমিকের পর তাই কলেজে না ঢুকে ভর্তি হয়ে গেল ফটোগ্রাফি আর এডিটিং-এর কোর্সে। সায়েন্স অফ ফটোগ্রাফির কলা কৌশল, আলোর সীমিত  ব্যবহার, সূর্যের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ভিউ অ্যাঙ্গেল, স্টিল, মোশন, অ্যাপারচারের জানলা, শাটারের পর্দা, আই এস ও প্রভৃতি ফটোগ্রাফির মূর্ত ও বিমূর্ত দুনিয়া ও-কে পাগল করে তুলল।    
   এক দিন চলমান ট্রেনের নিচে ফেলে রাখল ওর প্রথম কেনা এস এল আর অন করে। ভেবেছিল ক্যামেরা শেষ। কিন্তু না। ট্রেন চলে যাবার পর ধুলো বালি সরিয়ে কালো ক্যামেরাটা দলা পাকানো সাপের চোখের মত জেগে উঠল
   শুধু ডান দিকের কোনায় একটু চল্টা উঠে গিয়েছিল। এর বিনিময়ে ও পায় এক আসাধারণ ভিউ। নিজের তোলা চলন্ত ট্রেনের নিচের দিকের চলমান ছবি শব্দ সমেত।   
   ও বুঝেছে ওর আকাঙ্ক্ষা মিথ্যা নয়। মন প্রাণ দিয়ে কেউ যদি কিছু কামনা করে তাই নাকি সত্যি হয়। কোথায় যেন শুনেছিল।         
   সেই ছোট বেলায় স্কুল থেকে একা একা সাইকেলে করে বাড়ি ফেরার সময় খিদে তেষ্টায় তীব্র  আক্রান্ত অবস্থায় সবুজ মাঠ চাকুর মত চিরে ফেলা কালো পিচের রাস্তার উপর দিয়ে ঢিমে তালে চলতে চলতে যা যা ও ভাবত বাড়ি ফিরে দেখত প্রায় কাছাকাছি কিছু ঘটেছে।
    যদি ওর মনে হত আজ মামা আসবে। গিয়ে দেখত পিসি এসেছে। যদি ভাবত আজ ওর জন্য বাড়িতে কোন উপহার অপেক্ষা করছে। বাড়ি গিয়ে দেখত ওর মা হয়ত ঘরের খাটের দিক পরিবর্তন করে দিয়েছে। কিছুই একদম ঘটত না, এর হার দশ শতাংশের মত। বাকি নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে ওর ভাবনা এই রকম অর্ধ-সফল হত।  
   এই ভাবনার খেলাটা ও কাউকে বলেনি কোন দিন। এটা ওর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। অবশ্য বললেও হয়ত কেউ বিশ্বাস করবে না।  

#
   গত সোমবার ওর তিরিশ বছরের জন্মদিনের রাতে ভাড়ার এই এক চিলতে ঘরে একা একা বিয়ার খেতে খেতে সেই রকমই একটা ভাবনার সঙ্গে ওর সংঘর্ষ ঘটে গেল।
   এবার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। আগাম কোন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আবেগ এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে মনে হয়েছিল এক্ষুনি ঘটবে ভয়ঙ্কর কিছু একটা। প্রচন্ড চাপ অনুভব করেছিল বুকে।
  কী সেটা! এই তিন দিন ধরে ও ভেবে যাচ্ছে। কোন সূত্র পাচ্ছে না। মনোযোগও দিতে পারছে না কাজে।
  তার উপর ডিরেক্টার বলছে একটা চরিত্র বাদ দিয়ে দিতে। যদিও ওর মনে হচ্ছে থাকলেই ভালো হয়। ডিরেক্টারের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে হবে।
 মাথায় এই রকম চাপ থাকলে কাজে মন বসে!

ওর চোখ এখন ল্যাপটপের দিকে। ডিসপ্লের উপরে বাঁ দিকে গোল কালো দাগটার দিকে বেশ কয়েক মুহূর্ত ও তাকিয়ে রইল।
এর সাথে কি ওর নবাগত ভাবনার কোন সম্পর্ক আছে!  



   
‘আমি কি আসতে পারি?


   শেলি দ্বিধা বিভক্ত। কল-টা রিসিভ করবে কি করবে না। ভাবছে। শেষে করেই ফেলল।
   -‘আপনি এখন কোথায়? কেমন আছেন?’ অপর প্রান্তের কণ্ঠ বলল।
   -‘কে বলছেন?’ শেলির পালটা প্রশ্ন
   -‘প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন হয় নাকি?’
   -‘আমি জানতে চাইছি, আপনি কে? জাস্ট এই টুকু।‘
   -‘আমি... মানে... আমি  বলছি।‘
   -‘তা...আমিটা কে?’
   -‘আমি কে! সম্ভবত আমিও জানি না। একটু চিন্তিত ছিলামতাই ফোন করলাম।‘
   -‘চিন্তিত কেন?’
   -‘আপনার জন্য।‘
   -‘আমার জন্য? আমার আবার কী হয়েছে?’
   -‘হাসাচ্ছেন কেন এই রাতে?’  
   কন্ঠ সত্যি হাসছে মনে হল। শেলি এবার বিরক্ত ভাবে জানতে চায়- ‘আচ্ছা, আপনি ঠিক কে বলুন তো? আমার মোবাইল নাম্বার কোথা থেকে পেলেন?’
   -‘জানাব। জানাব। সব জানাব। এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?’

(ক্রমশ)
  


2 comments:

  1. ভিন্ন আবেগ রয়েছে । স্টাইলটা দারুন

    ReplyDelete