রাধারানী
দেবী এই নামটি বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে আজ বিস্মৃত একটি নাম। রাধারানী দেবীর জন্ম ১৯০৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর।বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের চারণভূমিতে যে
গুটিকয়েক মহিলা সাহিত্যিকদের নাম পাওয়া যায় রাধারানী দেবী তাঁদের মধ্যে
অন্যতম।তিনি যে সময়ে সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশ করেন তখন বাংলা সাহিত্য নানাভাবে
পুরুষ সাহিত্যিকদের দ্বারা সমৃদ্ধ, তদসত্বেও নিজের প্রতিভার উজ্জ্বলতায় সে ধারার
ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।তিনি বিশ্বাস করতেন এই সমাজের তমসা
ঘোচাতে কেবল পুরুষই নন,নারীজাতির বিশেষ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন।আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও
মননশীলতা তাঁর সাহিত্যের অন্যতম আকর্ষণ।বিশের দশকে প্রিয়ম্বদা দেবী,কামিনী রায়েদের
মতন ধারাকে সুচারুভাবে এড়িয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ও স্বতন্ত্র পথ তৈরী করেন।প্রচলিত
রোমান্টিকতা বা শোকাচ্ছন্ন কাব্যধারাকে দূরে রেখে নিজ দিগন্ত আঁকতে পেরেছিলেন
তিনি।রাধারানী দেবীই অপরাজিতা ছদ্মনামে দীর্ঘ ষোলো বছর লিখেছেন।এই সময় তাঁর লেখায়
দেখতে পাই আমরা জীবনের নির্মোহ ও নির্মম বর্ণনা, গভীর জীবনদৃষ্টি, যুক্তিবাদী
মানসিকতা ও স্বচ্ছ রসবোধ। ১৩৩০ বঙ্গাব্দ থেকেই ভারতী, ভারতবর্ষ, মর্মবাণী প্রভৃতি
সাময়িক পত্রিকায় তাঁর কবিতার আত্মপ্রকাশ শুরু হলেও তাঁর সাহিত্যের বিকাশ ঘটে
পারিবারিক পত্রিকা ‘সুপথে’। এসময় ১৯২৯ সালে
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লীলাকমল’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় ‘
বুকের বীণা’ যা বাংলা কাব্যজগতে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই শুরু
হয় অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামের যাত্রার। এই কবিতাগুলি ‘ Dramatic monologue’ এ লেখা। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘
সিঁথি মৌর’ ‘ আঙিনার ফুল’ ‘পুরবাসিনী’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ৯ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৯ সালে তাঁর মৃত্যু
হয়।
আবার এসেছে আষাঢ়
রাত থেকে কাল নেমেছে বাদল, হাতে নেই
কোনো কাজ।
পড়শির বাড়ি মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন
আজ.।।
বাড়ির কর্তা বিদেশে আছেন;
ছেলে-পুলেগুলো সব
বেলাবেলি সেজে গিয়েছে বে বাড়ি, ঘরে
নেই কলরব।।
নিজ্জন বাসা স্তব্ধ নিরালা, একেবারে
চুপচাপ।
একঘেয়ে সুরে কানে আসে শুধু বৃষ্টির
ঝুপঝাপ।।
হেঁসেল ঘরের শিকল বন্ধ, নেই আজ হাড়ি
ঠেলা।
বহুদিন বাদে বাতায়নে তাই বসেছি
বিকেলবেলা।।
আকাশ হয়েছে মলিদা রঙের, - তারি পানে
চেয়ে আছি।
যদিও কোলেতে নেই মেঘদূত, বীণা নেই
কাছাকাছি।।
বকুল-মালিকা কোনো মালবিকা দেয়নি আমায়
এনে।
এলায়নি কেশ, এলো-খোপা শুধু নিজেই
বেঁধেছি টেনে।।
তালে নেই মোর অলকাতিলক, তনুতে
পত্রলেখা।
ভবন-বলভি-শিখরে আমার নাচেনা মত্ত
কেকা।।
যূথিপরিমলে গৃহগুহা মোর মোটে নয়
সুরভিত।
প্রবাসী প্রিয়ের বিরহ-দহনে গুমরি
দহেনা চিত।।
তবু আজিকে বহুদিন বাদে দেখি এ
অস্ত-বেলা
গিরিতে গিরিতে নব আষাঢ়ের মেঘের বপ্রখেলা।।
সিক্ত মাটির সোঁদালি গন্ধে নব
অনুভূতি লাগে।
অতীত দিনের ছোটখাটো স্মৃতি মধু হয়ে
মনে জাগে।।
মনে পড়ে কবে এমন দিনেতে পড়াশুনো সব
ভুলে
মেঘের কবিতা লিখেছি গোপনে অঙ্কের
খাতা খুলে।।
এ হেন উতল ধারা-মুখরিত সজল আঁধার
সাঁঝে –
রবি ঠাকুরের বরষার গান বেজেছে কণ্ঠ মাঝে।।
গগনে এমন ধূমল কৃষ্ণ মন্থর মেঘ-ভার।
তুলিত আমার তরুণ হৃদয়ে ছন্দের
ঝঙ্কার।।
অকারণ ব্যথা অজানা বিরহে কাঁদিত
হৃদয়বধূ।
মেঘের মায়ায় বনেতে ছায়াটি নয়নে লাগিত
মধু।।
আজো বাতায়নে বসেছি আবার, সেই আমি সেই
‘ রুনু’।
কানে বাজে সেই বসা নটীর নূপুরের রুনু
ঝুনু।।
চিকণ সবুজ পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টিধারার
চিক
স্ফটিক-পদ্দা দিয়েছে টাঙ্গিয়ে দেখি
চেয়ে অনিমিখ।।
শিখরে শিখরে শুভ্র মেঘের চপল
ঝুলন-মেলা।
শ্যামল-ভ্যালির স্নিগ্ধ বুকেতে
শ্রাবণের লীলা-খেলা।।
সুনীলকান্ত মণিনিভ মেঘ সুদূর শৈল
শিরে
দিয়েছে পরায়ে রঙিন কিরীট উন্নত চূড়া
ঘিরে।।
সবুজের বুক চিরে চলে গেছে সিঁদুরবর্ণ
পথ –
নব-বিবাহিতা শ্যামা রূপসীর রক্তিম
সিঁথিবৎ।।
সোজা সুদীঘল পাইনের দল দোলে গান গেয়ে
গেয়ে।
ঝির ঝির ঝির করে জলকণা ঝাউয়ের ঝরোকা
বেয়ে।।
দ্রিমি দ্রিমি দ্রিমি বাজিছে মাদল
দামামা নাকাড়া নানা।
পুঞ্জে পুঞ্জে চেরাপুঞ্জির মেঘ-সেনা
দেয় হানা।।
পার্ব্বতী বালা ‘থাপ্পা’ বাহিয়া ভিজে
চলে গেয়ে গীতি।
বাদল-ঝাপসা্ পাহাড়িয়াপণ গিরিদরী
বন-বীথি।।
ঝর্নার কোলে ফুলে ছেয়ে গেছে
লতাগোলাপের ঝোপ্।
বৃষ্টি ও মেঘে রৌদ্র ছায়ায় রচিছে
বায়োস্কোপ্।।
আপনার পানে আপনি তাকায়ে বিস্ময়ে আজ
ভাবি,
সেদিনের সেই মনের দুয়ারে কেবা আজ
দিলো চাবি।।
কোথা হৃদয়ের সেই অনুভূতি ভাবাকুল সেই
প্রাণ!
রুপ-রস-হীন সংসার কৃপে দিন করি
গুজরাণ।।
সদা আনন্দে উতল-হৃদয়া লীলাচঞ্চলা সেই
প্রাণউচ্ছলা অতীতের ‘রুণু’-আজ আর
বেঁচে নেই।।
আজো তো আকাশে এসেছে বরষা- হেসেছে
ধরার রূপ।
হৃদয় আমার মুখরিছে কই? – মৃতের মতোই
চুপ।।
ননদিনী
বললেই রাগ করবে তোমরা
নীল মিনে করা দু-ভরি ভোমর
ইয়ারিং ছিল ন-বৌয়ের কানে।
হারালো সেদিন কোথায় কে জানে।
শুনছি আবার বেড়িয়ে শালকে
মেজবৌ নাকি এসেছে কালকে
খুঁইয়ে খোঁপার সাপ কাঁটাটাকে-
কথা বলবার জো নেই তো তাকে!
কেউ ভালো কিছু বললেই ডেকে
ফোঁস করবেন তিন ঘর থেকে!
মাথার কাঁটাটা গেল,নেই সাড়?
জানে ফের হবে-নেই কোন চাড়।
নিত্যি গায়ের গয়না হারানো,
সোনার জিনিষ ভাঙা বা সারানো
এ কি অলক্ষ্মী ডেকে আনা নয়?
বল যদি এটা তবে দোষ হয়!
ভাববে ননদ বজ্জাত বড়-
দোষ কিছু পেলে বকতেই দড়!
যা বলি,বলি তা ভালোর জন্যে!
তোমরা না বোঝো বোঝে তা অন্যে।
দ্বিতীয়পক্ষ আষাঢ়
আষাঢ় আকাশ ধূসর মেঘের
ধোসায় অঙ্গ মুড়িয়া,
দ্বিতীয়পক্ষ গৃহিণীরই মতো
দিয়াছে কান্না জুড়িয়া।
অর্থাৎ কিনা- সে আঁখিজলের
কারণাকারণ নেই তো,
এই রোদ হাসি চিক্ মিক্ – পুনঃ
বিপুল অশ্রু এই তো!
সময়াসময় নেই জ্ঞান মোটে
ক্রন্দন অনাসৃষ্টি,
কভু ফিস্ ফিস্ চুপি চুপি- কভু
প্রলয়ংকর বৃষ্টি।
অভিমানিনীর রূপ লাগে ভালো
ইনটারভ্যাল্ থাকলে; -
নতুবা এমন সারা দিনরাত
মুখ হাঁড়ি করে রাখলে
দুনিয়াটা ঠেকে মহা বিস্বাদ
লবণবিহীন সুক্তো,
বাড়ি ছেড়ে প্রাণ ক্লাবের গগনে
উড়ে হতে চায় মুক্ত।
বাসগৃহ যেন ঠেকে পিঞ্জর
প্রাণ করে সদা আইঢাই।
সুতরাং এসে বিগতা প্রেয়সী
জুড়িয়া বসেন মনটাই।
স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে বারবার
পুরাণো প্রথমপক্ষ!
নবীনা দ্বিতীয়া নানান শাস্ত্রে
যতই হোননা দক্ষ।
ক্ষণে ক্ষণে ক্রোধ সম – মেঘধ্বনি –
মাঝে মাঝে বাজ হানিছে।
উগ্রা প্রিয়ার ভীষণ বাক্য
চকিতে স্মরণ আনিছে।
ঝলকে আকাশে তীব্র বিজলি
চমকিয়া ওঠে চিত্ত!
মনে পড়ে সেই অগ্নিদৃষ্টি
ব্যাভার জ্বালানো - পিত্ত!
অসন্তোষের আঁধারে গিয়াছে
দিগদিগন্ত ছাইয়া,
অযুতে অযুতে অভিযোগ- মেঘ
দ্রুতবেগে আসে ধাইয়া;
ঝরে অবিরল ঝরঝর ধারে
নয়ন-আসার-বৃষ্টি,
আত্মবন্ধু পরিজন করে
ভেক- কলরব সৃষ্টি।
কোথায় কেতকী কোথা কদম্ব
কোথা বা ময়ূর নাঁচিছে?
পাঁকে ও কাদায় প্রাণ যায় যায়
আত্মা রৌদ্র মাগিছে!
এর চেয়ে ছিল শতগুণ ভালো
প্রখর জ্যৈষ্ঠ চৈত্র,
আমার হলোনা আষাঢ়ে লইয়া
কাব্যি অথবা মৈত্র্য
No comments:
Post a Comment