।। বাক্ ১২৫।। মান্টোবাজি ।। সিদ্ধার্থ মাইতি ।।









মান্টোবাজী


ফরিদ মিঞার বসার ভঙ্গী দু’হাঁটু মুড়ে নামাজ আদায়ের মত। আমার সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলছিলেন, একই ভাবে বসেছিলেন। তবায়েফদের অনেক গল্প বলার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কিস্‌সা লেখেন?’
— ওই আর কী —
— আমিও একসময় লিখতাম।
— এখন আরে লেখেন না?
— নাহ্‌।
— কেন?
— কিস্‌সা লিখলে বড় একা হয়ে যেতে হয়, জনাব। আল্লা যাকে কিস্‌সা লেখার হুকুম করেন, তার জীবন জাহান্নম হয়ে যায় জি।
— কেন?
— শুধু ছায়া ছায়া মানুষের সঙ্গে থাকা তো।
— তাই কিস্‌সা লেখা ছেড়ে দিলেন?
— জি জনাব। জীবনটা কারবালা হয়ে যাচ্ছিল। কারবালা জানেন তো?
— মহরমের কাহিনিতে —
— হ্যাঁ। কারবালা কি? সে কি শুধু মহরমের কথা? কারবালা মানে এই জীবন যখন মৃত্যুর প্রান্তর হয়ে ওঠে। কিস্‌সা লেখকের নিয়তিই এরকম জনাব।
— কেন?
— ওই যে, ছায়া ছায়া মানুষেরা সব সময় ঘিরে রাখে, তার সঙ্গে কথা বলে আর কী যে পাগলামির দিকে নিয়ে যায় ওরা। আপনার কখনও এমন হয় নি?
— হ্যাঁ।
— আপনার বিবি জিজ্ঞেস করেন নি কেন এই কিস্‌সাটা লিখলে?
 
— হ্যাঁ।
— আমাকেও কতবার বিবি জিজ্ঞেস করেছেন। কী বলব? আমি যা বলব, তাতেই তিনি হাসবেন আর বলবেন, আপ পাগল হো গিয়া মিঞা।
— তাই কিস্‌সা লেখা ছেড়ে দিলেন?
— জনাব, আমি আপনাকে চা খাওয়াতে পেরেছি। দাওয়াত দিতে পারব না, এই তো কিস্‌সা লেখক।
— তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। আমি তাঁর অন্দরমহলের চবুতরা থেকে ভেসে আসা পায়রাদের বক্‌বকম শব্দের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। একসময় তাঁর গলা কবুতরের ডাকের ধূসরতার ভিতরে ঢুকে পড়ল, ‘আমি একটা কিস্‌সা নিয়ে বড় মুশকিলে আছি জনাব।’
— কোন কিস্‌সা?
তিনি কোনও কথা না বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, “আপনি একটু বসতে পারবেন?”
— জরুর।
— কিস্‌সাটা তা হলে আপনাকে দেখাই।
— আপনার লেখা?
— না, ফরিদ মিঞা হাসেন। — একটু অপেক্ষা করুন, এও এক আশ্চর্য কিস্‌সা জনাব।
তিনি হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে চলে গেলেন। ভিতরে যাওয়ার দরজার ওপরে একটি মৎস্যকন্যা। হঠাৎ দৌড়ে কে একজন ভিতরে এসে ঢুকল। কালো লোমে ভরা একটা শরীর, আমার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বলতে শুরু করল, “মিঞা পাগল হয়ে গেছে আপনি জানেন না?”
 
— জানি।
— তা হলে?
— তার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি।
— কেন?
 
— আপনি কে?
— আমি মিঞার নোকর হুজুর। মিঞা আবার পাগল হয়ে যাবেন।
— কেন?
— আবার একা একা কথা বলবেন।
— কেন?
— কিস্‌সার কথা কেউ তুললেই
ভিতর থেকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতেই কালো লোকটি আবার চলে যায়, ‘হুজুর’ বলে দৌড়ে পালালো। আমার চোখ আবার সেই মৎস্যকন্যার শরীরে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল। একটু পরেই ফরিদ মিঞা পর্দা সরিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। এক পরিতৃপ্তির আলো তাঁকে ঘিরে আছে, আমার মনে হল। একটু আগেও তাঁকে বেশ অস্থির মনে হয়েছিল। তিনি বুকের কাছে ধরে রেখেছেন নীল মখমলে মোড়া একটা পুঁটুলি। সেইরকম নামাজ আদায়ের ভঙ্গিতেই বসলেন তিনি, যেন এক সদ্যোজাত শিশুকে শোয়াচ্ছেন, তেমন ভাবেই পুঁটুলিটা রাখলেন ফরাসের ওপর। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। — এবার আপনাকে আমি যা দেখাব, মনে হবে খোয়াব দেখছেন।
কী খোয়াব দেখাবেন আমাকে ফরিদ মিঞা? স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তো আমি এই সবে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এলাম। আর আমি এও জানি যে, আমাদের এই জীবন, যাকে বাস্তব বললে বেশির ভাগ মানুষ খুশি হয়, তাও অন্য আরেকজনের দেখা স্বপ্ন...
মখমলের আবরণ খুলতেই একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি জেগে উঠলো আলোয়। কোথাও কোথাও পোকায় কাটা...।
পাণ্ডুলিপিটাকে ফরিদ মিঞা শিশুর মত আদরে দু’হাতে তুলে নিলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন — দেখুন।
 
মানুষ যেভাবে পুরোহিতের হাত থেকে অঞ্জলির ফুল নেয়, সেভাবেই তাঁর কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটা নিলাম। খর খর শব্দ পেলাম। পাতারা কি সামান্য স্পর্শেও ভেঙে যাচ্ছে? ফরাসের ওপর পাণ্ডুলিপিটা রেখে পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করলাম। ঊর্দুতে লেখা; এই ভাষা তো আমি বুঝি না। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টেই আমি স্থির হয়ে যাই, লিপির সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করে রাখে, শুধু বুঝতে পারি, হারিয়ে যাওয়া অনেক সময় এখন আমাকে ছুঁয়ে আছে। একসময় ফরিদ মিঞাকে জিজ্ঞেস করি — কার পাণ্ডুলিপি?
— সাদাত হোসেন মান্টোর। আপনি নাম জানেন?
পাণ্ডুলিপির ওপর আমি ঝুঁকে পড়ে, আমার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর শোনা যায়—“সাদাত হাসান মান্টোর!”
কিস্‌সারা তাঁকে খুঁজে বেড়াত।
— আপনি কী করে পেলেন?
— এন্তেকালের কিছুদিন আগে আব্বাজান আমাকে দিয়ে যান। তাঁর কাছে কীভাবে এসেছিল – বলেননি।
আমি পাণ্ডুলিপির শরীরে হাত বোলাতে থাকি। আমার সামনে সাদাত হোসেন মাণ্টোর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি! বিশ্বাস হয় না। তবু আমি পাণ্ডুলিপি ছুঁয়ে থাকি। এই তো সেই কাহিনি-লেখক, তাঁর কবরের ফলকে লিখতে চেয়েছিলেন, কে বড় লেখক — খোদা না মান্টো?
 
— আপনি পড়েছেন? আমি জিজ্ঞেস করি।
— আলবৎ! কতবার পড়েছি মনে নেই।
— কী লিখেছেন মান্টোসাব?
— মির্জা গালিবকে নিয়ে। মির্জাকে খোয়াব দেখতেন মান্টোসাব। মান্টোকে নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছিল বম্বেতে। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন মান্টোসাবই। আপনি জানেন?
 
— না।
— মান্টোসাব তখন বম্বেতে ফিল্ম স্ক্রিপ্ট লেখেন। তবে দুঃখের কথা, ফিল্মটা যখন তৈরি হল, মান্টোসাব তখন ইণ্ডিয়া থেকে পাকিস্তানে চলে গেছেন। মির্জা গালিবের সেই প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুরাইয়া বেগম। ফিল্মটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। প্রথম হিন্দি ফিল্মের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া, বুঝতে পারলেন? মির্জাকে সারা জীবন মান্টোসাব ভুলতে পারেন নি। মির্জার গজল তাকে পাগল করত, মির্জার জীবনও। কত যে মিল দু’জনের মধ্যে —।
হ্যাঁ অনেক পাঠক এতক্ষণে উত্তজিত এবং লাগসই গালাগালের জমজমাট সাজ পরছেন। কারণ তাঁরা জানেন, যা এতক্ষণ লিখেছি আসলে কিছুই লিখিনি, টুকেছি। সাদাত হাসান মান্টোর মত অকালে চলে যাওয়া ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক রবিশংকর বল তাঁর গুরুত্বপূর্ণতম উপন্যাস ‘দোজখনামা’র প্রস্তাবনা করেছিলেন। মির্জা গালিব আর সাদাত হোসেন মান্টোর এক খোয়াবি কথোপকথনে দাস্তান বুনেছিলেন। পাঠক ক্রমাগত সে দাস্তানের সুড়ঙ্গের এক মোহময় জাদু পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে যেতে নিজেই দাস্তানের চরিত্র হয়ে পড়েছেন। অতিলৌকিক সে পরিক্রমায় কোথায় যে মাণ্টো আর গালিব এক সুতীব্র অভিমানী সহযাত্রী একমাত্র মরমীয়া বাঙলিই আবিষ্ট হয়।
মির্জা গালিব তাঁর সময়ে অবহেলিত, সমালোচিত এবং রাজাবাহাদুর শাহ্‌ জাফরের অনুগ্রহ বঞ্চিত। তাঁর প্রায় পাঁচশ বছর পর সাহদাত হোসেন মান্টো জন্মালেন এবং দলের বাইরে, ভিড়ের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে, ভিড়ের ভেতরের বিদীর্ণ-জীবন মুখগুলোকে আগাপাস্তালা চিনলেন। তাঁদের জীবনের গলিঘুঁজি ধরে রাত পরিক্রমা করলেন। তেলতেলে নধর ভরে ওঠা মানুষের দল চেটেপুটে নিংড়ে নিংড়ে নেয় ঐ পাঁশটে অস্তিত্বের সার সার জৈবিক নড়াচড়া। তাই তাঁর পেন্সিলের ডগায় উপচে পড়ল। তড়িৎ গতিতে উর্দু চিত্রলিপিতে এঁকে চললেন তাঁদের জীবনের কর্কশ খটখটে জীবনকাহিনি,তাঁদের আসনাই,তাঁদের স্নেহ,মমতা,প্রেম ভালোবাসার আফসানা। হ্যাঁ ফরিদ মিঞার কিস্যা,গালিবের দাস্তান,মান্টো বলতেন আফসানা । জীবনের পাঁচালি।। অগত্যা তিনি আক্রান্ত, সমালোচিত এবং লাঞ্ছিত এবং সেজন্যই তিনি রবিশঙ্কর বল-এর নায়ক। তাঁকে নিয়ে বাঙালি নাটক করেছে ১৯৯৩ নাগাদ। অভিনেতা-নাট্যকার-পরিচালক চন্দন সেন সাদাত হোসেন মান্টোর গল্প মিশিয়ে নাটক সাজিয়েছিলেন। হিন্দি নাটকের ঊষা গাঙ্গুলীও মান্টোকে নিয়ে কলকাতার রঙ্গমঞ্চে ফিরে ফিরে এসেছেন এবং শহরতলীর কিছু নাট্যদল। সাদাত হোসেন মান্টোকে নিয়ে প্রাক্‌ ২০০৯ এমনই চর্চা। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর রবিবারের ক্রোড়পত্র ‘রোববার’-এ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে শুরু করল। বহু সাধারণ পাঠক সেই সপ্তাহান্তিক রেশনের ভোক্তা হলেন। ইতিহাস পাগল বন্ধু আমার গৌতম, সেও শুধুই ভাষা আর চরিত্রের টানে ‘রোববার’ সংগ্রহ করে পড়েছিল জানা গেল। বই হিসেবে প্রকাশিত হল ২০১০-এর নভেম্বরে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা বঙ্কিম পুরষ্কার’-এ ভূষিত হল ২০১১-য় এবং ২০১২-য় সেই রবিশংকর বল-এর সম্পাদনায় প্রকাশ পেল সাদাত হোসেন মান্টো রচনা সংকলন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬ এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ — এই দু’পর্বে ভাঙা তাঁর রচনা। একটি নাটক ও চারটি প্রবন্ধ। এছাড়া বাকি সব গল্প।







নন্দিতা দাস ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে তাঁর ‘মান্টো’ বাজারে ছাড়লেন এবং ২১-শে সেপ্টেম্বর ছবি মুক্তি পাওয়ার প্রথম প্রদর্শনী দেশের কিছু হলে প্রযুক্তিগত ত্রুটিতে ভেস্তে যাওয়ায় তিনি ট্যুইট করলেন, আমার ছ’বছরের শ্রম ছারখার হয়ে গেল।
কলকাতার দ্বিতীয় প্রদর্শনী আমি দেখেছি, কোনও অসুবিধা হয়নি। কি দেখেছি সে প্রসঙ্গে আসছি আর একটু পরে। একটা কথা খেয়াল করার যে তিনি ছ’বছর ধরে ‘মান্টো’ নির্মাণ করেছেন। অর্থাৎ, বাঙালি পাঠক ২০১২ থেকে ২০১৮ — এই প্রায় সাত বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন নন্দিতা দাস-এর ‘মান্টো’ দেখবেন বলে। মনে রাখবো ২০১২ সাহদাত হোসেন মান্টোর জন্মশতবার্ষিকী ।
এর মাঝে ইরফান খান-এর যাবতীয় যোগ্যতা বাড়তি থাকা সত্ত্বেও নন্দিতা তাঁকে ছেঁটে অনেক কম মান্টো-সচেতন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী-কে সাদাত হোসেন মান্টো হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নিজেরই ঘোষিত চরিত্রলিপি বদলেছেন এবং বাজারের প্রয়োজনেই যে ইরফান খান বদলে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির বাছাই তাও জানিয়েছেন। ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে নানা নগরে তাঁর ছবি প্রচারের সভা করেছেন এবং কলকাতার দর্শককে জানিয়ে গেছেন বাঙালি ঋত্বিক ঘটককে খুঁজে পেতে পারেন তাঁর চিত্রিত ‘মান্টো’ চরিত্রে। না, ঋত্বিক ঘটক আর সাদাত হোসেন মান্টো এক নয়। মদ্যপান, আত্ম-অবক্ষয়, আত্মহননের মিল ছাড়া ঋত্বিক-মাণ্টো কখনোই এক নয়। মান্টো একক, ঋত্বিক আমৃত্যু বিপ্লবী। বামপন্থা রাজনীতিতে আত্মসমর্পিত। তাঁর কাজ চলচ্চিত্র এবং গোষ্ঠী মানুষের লড়াই। হ্যাঁ তাঁর ‘অযান্ত্রিক’ মাথায় রেখেই বলছি। ঋত্বিক দার্শনিক হয়ে ওঠেন, মান্টো প্রোপাগান্ডিস্ট,provocateur!
বাঙালি তৈরি ছিল বলেই ‘মান্টো’ চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পরে পরেই কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লেখেন, নওয়াজ কি পেরেছেন মান্টোকে আঁকতে। দেখে ফিরে লিখছেন, মান্টোর বায়োপিক দেখে, তা নিয়ে আমি লিখব! সে ছিল রবি। রবিশঙ্কর বল। আমাকে ঘাড় ধরে মান্টো চিনিয়েছিল, যেভাবে মানুষ ডেকার্স লেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট... কলকাতার অলিগলি চেনে আর নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। আমার মনে ইসমত চুঘতাই-এর জলছবি সেঁটে দিয়েছিল। দেখার আগে মান্টোর চরিত্রাভিনেতাকে নিয়ে নাক সিঁটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। তারপর মুভি দেখতে বসে ফ্রেম-টু-ফ্রেম স্তব্ধ হয়ে গেছি। চুঘতাইয়ের সঙ্গে মান্টোর বন্ধু-শত্রুর ভালোবাসা, অভিমান — আ! কবিতার মতো এঁকেছেন নন্দিতা দাস। ঠিক যেভাবে এঁকেছেন জীবনের সঙ্গে মান্টোর যোগাযোগ। এ ছবিতে কোনও কমফোর্টের জায়গা নেই। মর্বিডিটি যাঁদের শ্বাসকষ্ট ঘটায়, তাঁরা ইনহেলার ব্যাগে পুরো সিনেমাটা দেখতে আসবেন প্লিজ্‌। নিজের চোখে একটিবার দেখে যাবেন অবক্ষয়, ভাঙন, সৃষ্টিশীল মানুষকে কেমন কুরে কুরে খেয়ে ফেলে...।”
কিসের অবক্ষয়, কার ভাঙন! আমার চকিত প্রশ্ন ছিটকে উঠে আপাত শান্তির খোঁজে স্তব্ধ হয়। কবিতা না জীবন কোলাজ, বায়োপিক না ডক্যু-ফিচার ধাঁধা লাগে আমার। মর্বিড কি? আসলে মৃত্যু যে অনন্ত জীবনের তৃপ্ত লাল দাগে চিহ্নিত ‘ঘোর’ স্পষ্ট করে আমার মনে হয়।
২০১৪-র মাঝামাঝি বহরমপুরে আলাপ হয়েছিল লালবাগের মবিনুল হক দাদার সঙ্গে। তিনি উর্দু জানেন এবং ইসমত চুঘতাইয়ের গল্প সংকলন ‘লেপ ও অন্যান্য গল্প’ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। ‘লেপ’ গল্পটির প্রথম পাঠে আমি হতচকিত বিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। পরপর টানা তিনবার পড়ে ফেলে ইসমত চুঘতাই-এর পায়ে পড়েছিলাম। এ দুঃসাহসী নারী কে? কোথায় পেলেন এ গাঢ় কামতাড়িত সমলিঙ্গ যৌনতার নিখুঁত জ্বলন্ত সৃজনের স্পর্ধা ও ভাষা? সালাম করেছিলাম সবিনুল হক দাদাকেও।
সাদাত হোসেন মান্টোকে সব দর্শক চেনেন ভেবে যে তাঁর সব থেকে চর্চিত বা আলোচিত পাঁচটা গল্প নন্দিতা দাস ‘মান্টো’ চলচ্চিত্রের মেদ-চর্বি-ঘাম-রক্ত-মাংসে ভরে দিয়ে ফেলেন তা মনে হয় না। কারণ কান ফেস্টিভ্যালের সওয়াল-জবাব পরিসরে তাঁর আন্তর্জাতিক দর্শক দাবি করেন যদি লেখকের গল্প জুড়েই চিত্রনাট্য গড়ে উঠে থাকে, কেন নন্দিতা সেই গল্পের আগে-পরে ‘এবার গল্প শুরু’ ও ‘এবার গল্প শেষ’ গোছের নোটিস ভাসিয়ে দিলেন না! নন্দিতা ভাল করেই জেনেছিলেন, তাঁর মান্টোর সংলাপে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি লিখবেন, ‘আপনারা যা দেখেন সেগুলো লেখেন না, আমি শুধু সাহিত্যে উপেক্ষিত অচর্চিত মানুষের জীবন যেমন দেখি, ঠিক সেভাবেই লিখে যাই এবং তাই আপনাদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। আপনারা নিজেদেরকে ওভাবে দেখতে চান না। তাই আমি আপনাদের কাছে পরিত্যাজ্য।’ ২০১৬ নাগাদ নন্দিতা প্রায় মান্টোর প্রাথমিক টিজার-এর মত নওয়াজকে মান্টো সাজিয়ে ‘ইন ডিফেন্স অফ ফ্রিডম” নামে একটি ছোট ছবি বাজারে ছেড়ে চেখে নিয়েছিলেন বাজার নওয়াজকে কতটা নিতে পারছে। ঐ লাহোর কলেজে আমন্ত্রিত হওয়া মাত্র মান্টো যে তাঁর অবিরাম মদ্যপান প্রসঙ্গেই সচেতন করেন ছাত্রদের তাও মনে করিয়ে দিতে থাকেন। সে ছোট ছবিটি কিন্তু আস্ত মান্টো’র শরীরেও গুঁজে দেওয়া আছে। গল্প আর জীবন যে কখনই জীবন ও জৈবিক লক্ষণের মত জাপ্টাজাপ্টি ছাড়া আর কিছু নয়, তাঁর মান্টো প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্যে প্রমাণ করতেই থাকেন। ওয়াকিবহাল দর্শক শুধু বোঝেন শুরু একটি সদ্য কিশোরীর ঘিনঘিনে পুরুষের ব্যবহৃত হওয়ার কাহিনি দশ রুপয়ে দিয়ে এবং শেষ দেশভাগের চূড়ান্ত বেদনাময় কাহিনিতে। নো ম্যানস্‌ ল্যাণ্ডে আকাশমুখী দৃষ্টিতে পড়ে থাকা এক বৃদ্ধ,লাশ,তিনি ধর্মাচরণে শিখ,তিনি মানসিক রোগী একটা আস্ত দেশ ভেঙেছে হিন্দু ও মুসলমান পরিচিতির নিরিখে কিন্তু বাকিরা! এর মাঝে আরও তিনটি গল্প খাপে খাপে মেলানো আছে।
তাঁর শেফার্স বা অনেক নামী দামী কলম আছে এবং পেন্সিল। সাফিয়া তাঁর স্বামী সাদাতকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর পান পেন্সিলেই লিখবেন। টাইপরাইটারের খটখটানি তাঁর অপছন্দের। তাঁর ৭৮৬ দিয়ে শুরু করা আম্মিজানের কাছে করা শপথ বিশেষ কোনও ধর্মীয় অবতারের কাছে আত্মসমর্পণ নয়। এবং এই মান্টোই ধর্মাচরণ বিচ্ছিন্ন বা অবিশ্বাসী একটি মানুষ শুধুই পারিবারিক পরিচয়ে মুসলমান হয়ে যান, যৌবন সঙ্গী শ্যাম চাড্ডার চোখে। একটা বিশেষ ঘটনায় কিছু মৃত্যু ও তার আকস্মিকতা একজন সহজ বন্ধুকেও কত দ্রুততায় ঘাতক করে তুলতে পারে এও তাঁর জানার আরেক বেদনা। বেদনা। হতাশা নয়। জীবনের কাছে অগাধ প্রত্যাশা বা থাকলে কি কেউ নেশার আড়ালে প্রত্যাশিত প্রতিফলন খোঁজেন। অতিরিক্ত বিশ্বাস, অতিরিক্ত প্রত্যাশা তাইই না অমন অস্থিরতার অমন নিশিযাত্রা। জীবন জীবন জীবন। “অগর আপ মেরে আফসানো কো বরদাস্ত নহি কর সকতে, তোহ ইসকা মতলব ইয়েহ জমানা হি নকাবিলে বারদাস্ত হ্যায়!” “যদি আপনারা আমার গল্প সহ্য করতেই না পারেন তার মানে আসলে আমরা যে সমাজে বাস করি সেটাই অসহ্য।” এই অসহ্য বাস্তবতার রসদ জীবনের কাঁচা মাংস বা রক্ত উপচানো ঘায়ের ঘ্রাণ খুঁটে নিতে তাঁর অবিরাম হেঁটে চলা বা খানিক চায়ের বিশ্রামে ইরানি কাফের চেয়ার দখল করা। সায়গলের গান এবং আদা চায়ের ফাঁকে তাঁর চরিত্রদের আদল, আদবকায়দা চিনতে থাকেন। রাতের জুয়ার আড্ডা বা বেশ্যাপট্টির পথঘাটে তাঁর চরিত্ররা আফসানা হয়ে উঠতে থাকে।
বোম্বায়ের কুখ্যাত ‘সফেদ গলি’র ধুন্দু দালালকে পেয়ে যাই। ধুন্দ ১০ বছরের পেশাদার প্রমোদ-নারী অথচ কুমারী সেই ‘সিরাজ’-এর আফসানা ভদ্রলোকদের কাছে লেখার উস্কানি হয়ে ওঠেন। দিনের বেলা যে নারীকে পরিত্যাজ্য-ঘৃণিত, রাতের সফেদ গলিতে তারাই লালে-ঘামে চেটে নিতে ছুটে চলে আসে ভদ্রলোকেরা সেই নারীর ১৫ টাকা ভাড়া ঘরে। ১০ টাকায় কেনা সময়ে সেই ‘সিরাজ’রা তখন ‘দিল কি রাণী’! সাদাত হোসেন মান্টোর পেন্সিলে নিঃশব্দ করাতে কেটে কেটে ফালা ফালা করতে থাকে আপনার আমার স্বস্তির কপট বাঁচা। জীবনের বিচিত্র কোলাজে তাঁর বোম্বাইয়ের ‘আরব গলি’র বসত মহল্লার দুর্দান্ত ‘মাম্মদ ভাই’ শুধুই মাস্তানি করে না তার এলাকায়, তার এলাকার বাসিন্দার ‘দেখভাল’ করাও তার কাজের মধ্যেই পড়ে। মান্টো সাহেবের অসুস্থতার সুশ্রুষার ব্যবস্থাও যে মাম্মাদ ভাইয়ের দায়।বিসমিল্লাহ হোটেলেই তাঁর  খানাপিনা। সেখানেই মান্টো সহায় কে পায়। বেনারসের হিন্দু মুসলমান নারীর দালালি করে ধনী হওয়ার স্বপ্ন সহায়ের। মনে হয় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘লোয়ার ডেপ্‌থ’ যেভাবে ‘নীচের মহল’কে আমাদের পাঠকের চোখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সাদাত হোসেন মান্টো সেই চোখে জ্বলুনি ধরিয়ে দিলেন। ধুয়ে যাওয়া চোখের তারায় আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাঁর বোম্বাইয়ে নীচের মহলের আলো। পরিত্যাজ্য স্খলিত মানুষের অনন্ত মানবতার রসায়ন।
তিনি নিজেকে সারাক্ষণ বলতেন “চলতা ফিরতা বোম্বাই” অর্থাৎ চলন্ত বোম্বাই। তাঁর অস্তিত্বে আজকের মুম্বই সেদিনের বোম্বাই এভাবেই মিশে ছিল। ‘বোম্বাই কাউকে ফেরায় না’ এ বিশ্বাস তাঁর সব কথায় ফিরে ফিরে আসতো। রুপোলি দুনিয়ার স্টুডিওয় বারবার গেছেন, রেডিওর জন্য নাটক লিখেছেন। আমাদের বলিউডের ইতিহাসের হিমাংশু রায় থেকে অশোক কুমার তাঁর দামী সব বন্ধুদের তালিকায়। শ্যাম, তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ‘শ্যাম চাড্ডা’ তখন উঠতি সুদর্শন নায়ক। রাগী, ঠোঁটকাটা মান্টো বাম রাজনীতি প্রভাবিত Indian Progressive Writers’ Association–এর সঙ্গে বেশিদিন চলতে পারেননি। বাম নান্দনিক চর্চার রীতিনীতি আর তাঁর রাগে দ্বন্দ্ব পেন্সিলের চরিত্ররা যেসব রীতিনীতির খাঁচায় বাঁধা পড়তে পারেনি। সংগঠনের খাঁচা পেরিয়ে তিনি চলে এলেও পেয়েছিলেন সেখানকার ইসমৎ চুঘতাই ফৈয়াজ আহ্‌মেদ ফৈয়াজের মত সঙ্গী। ইসমৎ এরপর তাঁর বৌদ্ধিক প্রেমিকা হয়ে পড়বেন। দুজনেই খরশান লেখনীতে হেনে চলবেন ভদ্দরলোকেদের প্রমিত চর্চার নিশ্চিন্ত পরিসর। এবং ইসমত চুঘতাই সাদাত হোসেন মান্টো দুজনেই নীতিপুলিশদের আদালতি ফরমানে ক্ষতবিক্ষত হতেই থাকবেন। এক দেশ ভেঙে দু’দেশের জন্ম মুহূর্তে যেমন কাতারে কাতারে মানুষ আলোর রোশনাইতে রাজপথ ভাসাচ্ছেন, উল্টোদিকে অন্ধকারের দেশ দাঙ্গায় রক্তাক্ত হচ্ছে, চিনি নিতে হচ্ছে গলিতে মহল্লায় হিন্দু না মুসলিম রক্তে রক্তে ভিজে যাচ্ছে সমস্ত ভয়ানক হিংসার প্রলাপ। পকেটে হিন্দু-মুসলমান দুরকম টুপি নিয়ে মান্টো নিজেকে আঘাত থেকে বাঁচাতে পারেন তবে একান্ত বন্ধু শ্যাম চাড্ডা আচমকা জানিয়ে দেন মান্টো কিন্তু মুসলমান বলেই হননযোগ্য। ব্যাস্‌ এখান থেকেই ছেড়ে যাওয়া ‘চলতা ফিরতা বোম্বাই’-এর বোম্বাই ত্যাগ। করাচি চলে যাওয়া। বাবা-মা ও প্রথম সন্তানের কবর পড়ে থাকল স্বাধীন ভারতবর্ষে। তিনি চলে গেলেন স্বাধীন পাকিস্তানে। দু’দেশের মানুষ সমান তালেই হেনে চলেছে রুক্ষ্ম লালসা আর অক্লান্ত বাসনার গণগণে তাপে, লোভে। পাকিস্তানে ২০১২-র সাদাত হোসেন মাণ্টোর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন থেকেই চর্চার রমরমা ঘটে। টিভি ধারাবাহিক থেকে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ২০১২ থেকে ২০১৫ পাকিস্তানের মান্টো সন্ধান। একুশ পর্বের ‘সাদাত হোসেন মান্টো’ ধারাবাহিকে জনপ্রিয় অভিনেত্রে সাবা করিম অভিনীত লাহোর চলচ্চিত্রের সুন্দরী নায়িকা নূরজাহানের সঙ্গে উসখুশে প্রেম প্রায় চার-চারটি পর্ব। মাতাল, রগচটা মান্টোর যাবতীয় জীবনচর্যা পাকিস্তানি জীবনীচিত্রে ভরে দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদেরকে চিত্রধারা ১৯৪০-৬০ এর হলিউডের বোম্বাই ধারা।
নন্দিতা দাস চিত্র নির্মাণে আজকের হলিউডের চারিয়ে দেওয়া বিশ্বভাষা।
নন্দিতা দাস সুদীর্ঘ গবেষণায় চারটি বছর খুঁজে নিলেন। ১৯৪৬, ১৯৪৮-’৫১। তাঁর উদ্দেশ্য ‘মান্টো’র মাধ্যমে দেশভাগের ভয়াবহ দাঙ্গার চেহারা, তিনি দেখালেন চলচ্চিত্র শিল্পের মানুষরাও সম্প্রদায় বিভাজনে কুটিল হয়ে পড়ছেন। তিনি দেখাচ্ছেন উদ্বাস্তু শিবিরের স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্ধার করা নারী শরীরে পৌরুষের নৃশংস উদ্দাম উল্লাসী অত্যাচার। সেখানে যে ‘খোল দো’ গল্পের চিত্ররূপ করে দিচ্ছেন নন্দিতা। নন্দিতা জানতেন দর্শক ছবি দেখবেন ওয়েব স্ক্রিনে। অর্থাৎ বড় ডেস্কটপ টার্মিনাল কি ল্যাপটপ বা স্মার্ট টিভির পর্দার পরিসর মাথায় থাকে তাঁর। পারতপক্ষে লং শট এড়িয়ে গেছেন। মিড, মিড লং, ক্লোজ — ব্যাস্‌ এই ফ্রেমেই তাঁর ছবি। সিপিয়া রঙে ছেয়ে দিয়েছেন সত্তর বছর আগেকার দৃশ্যাবলী। স্টেডি ক্যামেরা বা ট্রলি কখনও কখনও টপ শটে ক্যামেরা ঘোরান।কার্তিক বিজয়।আজকের চলচ্চিত্র ভাষায় সচেতন,তিনি জানে নন্দিতা দাস মানে কান টরন্টো ফেসটিভ্যাল ভাসাবে। রচিত গল্প আর চিত্রনাট্যের ঘটনা মিশে যাওয়ার সূর্য প্রসাদের শার্প এডিটিং চমৎকার। আবহতে বেসুরো সেতার কখন যে কি ঘনঘোর হয়ে ওঠে স্বীকার করতেই হবে। আবহ বেঁধেছেন জাকির হোসেন। স্নেহা খানওয়াকার ৪০এর গান খুঁজে বেঁধেছেন।
নন্দিতা মান্টোর ভাবজগৎ আর আহত আত্মার মুখাবয়বে আলো-আঁধার ভরে দিতে নওয়াজের অস্বাভাবিক মুখপেশী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার ওপর ভরসা রাখছেন। নওয়াজের অভিনয় নিয়ে কথা হবে না। কথা হবে না রসিক দুগ্‌গাল, রাজেশ্বরী দেশপাণ্ডেদের অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে।
আমরা জেনেছি মান্টো বোম্বাইয়ের সমস্ত চিঠি সযত্নে আলমারিতে ভরে রাখেন। পড়েন না। মাঝে মাঝে দেখে নেন শুধু কারা তাঁকে মনে রেখেছে। জানতে পারছি ভদ্রলোকদের শান্তির বাঁচা কেড়ে নেওয়া না দেখতে চাওয়া ঘিনঘিনে বাস্তবতা মান্টোর লেখনীকে তথ্যচিত্রের কর্কশ আঘাত হানে অগত্যা লেখা না ছাপার যথেষ্ট কারণ ছুটে যায় পত্রিকার কর্তৃপক্ষের। জানতে পারছি অশ্লীলতার ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ তাঁকে আদালতের কাঁটাতারে বাঁধতেই থাকে। তিনি নিঃস্ব হতে থাকেন আর স্বভাবতঃই নেশার পরিমাণে আত্মগ্লানি আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিতেই থাকেন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বন্ধু ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজ বন্ধু ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’কে সাহিত্যের মাপকাঠিতে সাধারণ বলেই চিহ্নিত করছেন। মান্টোকে চকিতে ছারখার করে দিয়ে ফৈয়াজ তাঁর নীতি ফৈয়াজ তাঁর নীতি সত্ত্বা অটুট রাখেন। মান্টো ক্ষতবিক্ষত হয়ে যান। আমরা দেখেছি মান্টো দেখছেন বোম্বাইয়ের বন্ধু শ্যাম চাড্ডার লাহোর ভ্রমণে নায়কের জৌলুস হুল্লোড়ে ছেয়ে গেছে। লাহোরের অলিতে গলিতে একদা আসনাই শ্যাম ভুলে গেছেন। হারিয়ে গেছে তাঁদের দুজনের ঝলমলে যৌবন। শ্যাম বোম্বাইয়ের স্টুডিওয় ঘোড়া থেকে পড়ে অপঘাতে মরছেন এবং সে খবরটুকু পেয়েই তাঁর আবার মানসিক বিপর্যয়। শেষ যোগাযোগ চলে গেল চলন্ত বোম্বাইয়ের জীবন থেকে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সাম্যের জন্য লড়াই — এই তো মান্টো। সেই ‘মান্টো’ তাই নন্দিতার চলচ্চিত্র। দর্শকমণ্ডলী প্রগাঢ় মমতায় মান্টো পাগলাগারদের দেওয়াল দেখেন। পাগলদের ধর্মভাগে দেশপাল্টে যাওয়ার স্বার্থপীড়িত  পরিকল্পনা ‘তোবা টেক সিং’ গল্পের অনবদ্য চিত্ররূপ দেখি। ধর্মের হানাহানিতে ধর্ম বদলায় না মান্টোর কথা জ্বলে ওঠে।। সাবাশ সাবাশ রব ওঠে — নন্দিতা সাবাশ! কিন্তু ব্রেখটীয় চিন্তায় ধাক্কা লাগে। আজকের বাস্তবতার ছবি দেখে নিজেদের প্রতি তীব্র ঘৃণা উপচে পড়ে না দর্শকের। চারপাশের বাস্তবতায় সাদাত হোসেন মান্টোর বাস্তবতায় সাদাত হোসেন মান্টোর বাস্তবতা অপরিবর্তিত দেখেও রাগে, ক্ষোভে কোনও দর্শক উত্তেজিত হয়ে পড়েন না। তাঁদের মন থাকে Indian Progressive Writers’ Association নীতির জন্য বন্ধুকে ত্যাগ করতেই পারে। তাএর মনে থেকে যায় মাতাল মান্টো লিভারের অসুখে সুস্থ হয়ে পড়েন। নিজের সন্তানের ওষুধ কেনার টাকায় মদের দোকানে খরচ করেন মাণ্টো। কারণ নন্দিতা মান্টোকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ দেখাতে চান না। তিনি যেমন ছিলেন—মান্টোকে তাই-ই দেখিয়ে তাঁর বিবেকের মোটা পলেস্তারা অগোপন রাখতে চান না হয়তো। মাণ্টোর শ্যুটিং গুজরাটে আর অমৃতসরে। সেখানে ‘মান্টো’কে ‘U/A’ দিয়েই ছাড়ে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তিনি পেয়ে যান। কারণ রাগ নয়, ক্ষোভ নয়, দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে মান্টো শেষ। আত্মসমীক্ষা বা সুখের পশমে বেঁচে থাকার ওমে কোথাও কি ব্যাঘাত ঘটলো কিম্বা তীব্র জ্বালা আত্মগ্লানি! উথলে ওঠা আবেগ নিংড়ে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার বেদন!! না হলো না।কুচিকুচি  গল্প কথায় ফুরিয়ে যায় মান্টোবাজী।অবশ্যই খানিক ঔৎসুক্য বাড়ে।বই বাজারে টান আসে। শুভ্রাংশু দে তাঁর বিপনীতে মান্টোর রিলিজের পর দোজখনামা ও মান্টোর রচনাবলির বিক্রি বেড়েছে জানান। অবহেলিত বিতর্কিত প্রতিবাদ চিরকাল বাঙালির প্রিয়।দেবব্রত বিশ্বাস, ঋত্বিকের পাশে মান্টো বাঙালির আহা রে বলার আরেকটি নাম। সেই তবে হাতে রইল পেন্সিল। না মান্টোর সেই গনগনে পেন্সিল নয়।অবশ্যই। নন্দিতা মান্টোবাজির ডাক পেড়েছেন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে। সে মান্টো কি প্রান্তিক মানুষের বঞ্চনার গভীরে সতেজ জীবন আঁকার চেতনা,সে মান্টো কি সোজা কথা সোজাসাপ্টা ছেপে আদালতি লড়াইয়ে মেতে থাকা। নিরন্তর আত্মপীড়ন মগ্ন বেখেয়ালি যাপন!!! মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এভাবেই জোরালো হবে?


No comments:

Post a Comment