।। বাক্ ১২৫ ।। এ মাসের কবি শম্ভু রক্ষিত ।।






                                       "......... এক ধরণের ছেনি-শাবল আমার চাই -
                                  যা কিছুটা অন্যরকম,রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের নয় -
                                 ঠিক খেলার মাঠে স্টার্টারের পিস্তলের মতন  - রেডি -
                                  আমি বাঘের মতো লাফিয়ে পড়বো - খবরদার -  "


                                                                                     -'আমি স্বেচ্ছাচারী'






নাগরিক অন্তঃসারশূন্য মেকী উজ্জ্বলতা ও প্রচারসর্বস্ব অশ্লীলতার যাবতীয় তমসা থেকে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে বসে থেকে যিনি অকুতোভয়ে উচ্চারণ করেন,"আমরা সকলেই পরীক্ষা দিতে বসেছি, খাতা জমা রেখে যেতে হবে, মহাকাল কাকে কত নম্বর দেবে তার ওপরেই নির্ভর করছে কবি ও কবিতার ভবিষ্যত, খাতা জমা দিয়ে চলে যাবো, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর খাতাগুলো দেখা হবে, যদি কিছু সারবস্তু থাকে, পাশ করবেন, নাহলে গোল্লা!!" সেই কবি শম্ভু রক্ষিতের পিতৃপুরুষের ভিটে মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটা থানার বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে, জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট হাওড়ার ১১, ঠাকুরদাস দত্ত বাই লেনে মাতুলালয়ে। পিতা নন্দলাল রক্ষিত ছিলেন ব্যবসায়ী, হাওড়ার দাশনগরে তাঁর একটি লোহার সিন্দুকের কারখানা ছিলো। মা রাধারানী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। কবির প্রাথমিক শিক্ষা সুতাহাটার পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বৃত্তি পরীক্ষা পাশ করে হাওড়ার কদমতলায় চলে আসার পর মাধ্যমিক স্কুল জীবন শুরু হয় ব্যাঁটরা মধুসূদন পালচৌধুরী স্কুলে। তিনি পরবর্তীতে নরসিংহ দত্ত কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেও প্রথাগত শিক্ষার প্রতি প্রভূত অনাগ্রহের কারণে তা সম্পূর্ণ করেন নি।

বিশুদ্ধ কবির জীবনকে তার কবিতা থেকে পৃথক করে দেখা পাপাচারেরই নামান্তর হয়, হাংরি আন্দোলন নিয়ে কবির তুমুল আগ্রহের ফলশ্রুতি ছিলো নিজস্ব সম্পাদনা ও প্রকাশনায় হাওড়ার বাড়ি থেকে প্রচারিত হওয়া "ব্লুজ" পত্রিকা, অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত "Violation Of Democratic Rites"-এর তৃতীয় খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৯৭৬  সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিতের উপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিলো আর তারপর বিনা বিচারে তাঁকে আট মাস আটক রাখা হয়েছিলো, ১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া মামলার জেরে "ব্লুজ" পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়, হাংরি জেনারেশনের রূপকার মলয় রায়চৌধুরী শম্ভু রক্ষিতকে "সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি" স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন-.. ... " শম্ভুর একটি লেখা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন করে গজিয়ে ওঠে তা এক রহস্য,কবিতা বিশেষটি আরম্ভ করে শম্ভু ক্রমশঃ ভঙ্গুর ডিকশানের মাধ্যমে তার গঠনবিন্যাসের ল্যাবিরিন্থে নিয়ে যান, ছবি পুরো গড়ে ওঠার আগেই অন্য ছবিতে চলে যান,ষাট,সত্তর,আশি,নব্বই দশকের কবিতার যে ধারা তার সঙ্গে শম্ভুর কবিতার মিল নেই, তিনি নিজের বাক্য সাজানোর কৌশল গড়ে ফেলেছেন এবং তা থেকে কখনও সরে যাননি,আশে পাশে নানারকম আন্দোলন ও শৈলী নিরীক্ষা সত্বেও"......  মলয় রায়চৌধুরীর বিশ্লেষণ অনুসারে শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুলি রাইজ্যোম্যাটিক, বহুরৈখিক, ম্যাক্সিমেলিস্ট, ফ্র্যাগমেন্টারি, নন-টাইটেল হোল্ডিং, আয়রনিকাল এবং অবশ্যই টেকনিক্যালি আঁভা গার্দ। 

মাত্র তেইশ বছর বয়সে "তুমি কণিকা ও সূর্যের মধ্যে বিন্দু ও বিস্ফোরণজাত গোলাপ" -এর মতো লাইন সংবলিত শম্ভু রক্ষিতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না' (১৯৭১) তে আমরা অসম্ভব দার্শনিক প্রৌঢ়তার আভাস পাই "তোমার নিঃসঙ্গতা আমায় উপহার দেয় দীর্ঘ আনন্দময় সমাধি', কবি রমিত দের বিশ্লেষণে স্বেচ্ছায় মূলধারার বাইরে থেকে যাওয়া কবি শম্ভু রক্ষিতকে ইতিহাসের অমরত্বে উত্তীর্ণ হতে দেখি--".....তার নিজস্ব এক দূরত্বের ধারণা,এক অননুকরণীয় ভাষা,আত্মভেদী শব্দকোষ যা চিরমুক্ত প্রবাহ থেকে প্রবাহমানে,আরম্ভ থেকে সে চলেছে নতুন আরম্ভের দিকে,অহংকারের দিকে,তার ভাষা নিরাকার,দর্শন থেকে শুরু করে মহীলতার পরাবাস্তববাদ-গভীরতায় ঠাসা তার কবিতাগাথা,তার কোলাহল,তার লবনমুক্ত তন্ময়তা,বাংলা কবিতার স্রোতের বিপক্ষে তিরিশ দশক ধরে গড়ে তোলা তার ঘর-মাটি-আলো-জল যা তাকে সারস্বতের গুণগ্রাহিতা নয় বরং শিখিয়েছে বিশুদ্ধ কবিতার জনক হিসাবে নিজেকে অতি নিপুণভাবে প্রবীণ করে তোলা।" 

এই অবধি তার 8 টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,'সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ', 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না', 'রাজনীতি', 'পাঠক,অক্ষরগুলি', 'সঙ্গহীন যাত্রা', 'আমার বংশধররা', 'আমি কেরর না অসুর', 'ঝাড় বেলুনের জোট', ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর গল্প সঙ্কলন 'শুকনো রোদ কিংবা তপ্তদিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি' এবং একমাত্র উপন্যাস 'অস্ত্র নিরস্ত্র' (১৯৮০)। তিনি আমেরিকা নিবাসী বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগীদের দেওয়া 'শব্দগুচ্ছ' পুরস্কার প্রাপ্ত। তাঁর কবিতা ইংরেজি ও হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন "সত্তরের আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ও সম্ভাবনাময় কবি শম্ভু রক্ষিত", শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন "তার কবিতা সমকালের পাঠকরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও আগামী দিনের পাঠকরা সঠিক মূল্যায়ন করবে।" গত চল্লিশ বছর ধরে আজও এই কবি নিজে প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে ছাপা অবধি "মহাপৃথিবী" নামের ব্যতিক্রমী কবিতা পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন। তাঁর অমোঘ উচ্চারণ ------

                                  "কবিতা ছাড়া অন্য কোনও পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই"



                                                                               (কৃতজ্ঞতা: চন্দন দাশ ও শিবাশিষ দত্ত)





শম্ভু রক্ষিতের একগুচ্ছ কবিতা





১.   সোনার দাসী 


অনেক দূর দেশ ঘুরে আমার সোনার দাসী আসে
আমি সংক্ষিপ্ত গলিপথ থেকে ঘরে কোলে করে নিয়ে আসি তাকে।

সোনার দাসী,যাকে প্রজাপতির মত দেখতে-
আমি চোখ বুজে শুঁকি যার টকটকে লাল সিল্কের জামা,গর্ভের শিরা
যার শুকনো অল্প চুল মাথার ওপর দুভাগ হয়ে
আমার কানের পাশে জটার মত ঝোলে।

আমার ঘরে লোহার খাট,জামাকাপড় রাখার দেরাজ
দেয়ালের মধ্যে মার্বেল পাথর বসানো কয়েকটা ড্রয়ার
এবং আখরোট কাঠের ওপর খোদাইকাজ করা ছোট্ট একটা টেবিল
যেন স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে থাকে।

আমি অবৈধ কার্পেট পুঁথি,ছেঁড়া কাপড় সোনার দাসীকে পরাই।
আমি হেসে তার সঙ্গে কথা বলি,তার জন্য আমার নিশ্বাস,
আঙ্গুলের সাদা হাড় তাকে দেখাই,তার জন্য আমার জলস্তম্ভ
এবং আমার জন্য তার দ্বিতীয় সত্তা অনেক দূরে চলে গেছে।

আমি সোনার দাসীর মনের কথা চিন্তা করি,সগর্বে উদাসীন হই
ফলে সোনার দাসী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে
বায়ুমণ্ডলের মতো তাকে মনে হয়
সে রঙিন বাদ্যযন্ত্র ও টুপি নিয়ে আমার সঙ্গে আমার সঙ্গে লড়াই লড়াই খেলে
আমি দেখি তার দীর্ঘস্পন্দিত খেলা,দীর্ঘ অঙ্গসঞ্চালনও করি
সোনার দাসীর অনুপক্রীড়ায় এখন আমার মূর্ত শরীর-

আমার ও সোনার দাসীর খেলা দেখে নিরাবরণ বুড়িরা উঁচুবাড়ি থেকে
বেরিয়ে আসে,সোনার দাসীকে তারা দয়াময়ের বাতাস দিতে থাকে
তাকে ঘিরে ধরে পাথরের পতগ লাগানো ওদের গুলবদন সম্ভ্রম।

চতুর্দিক দেখা বারুদের মতন সোনার দাসী শীতল মনে হাই তোলে
তার নিহিত চোখের ভেতর হতে অনর্গল রশ্মিকণা আসতে থাকে
তার জালি চোখ,উত্তপ্ত লাল ঠোঁট-ঝালর লাগানো স্মৃতি-

তার শরীরে আমার বেদনা মাখানো গন্ধ

আমি ও সোনার দাসী আমরা দুজনে এখনও স্পষ্ট,স্ফীত
আহরিৎ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে যাই প্রায়ই নিচে।


২. তোর ঈশ্বরের নাম বল


আমার মৃত্যুর পর তোকে আর যন্ত্রণার তাঁত বুনতে হবে না
বল দেখি,আমার লেখা গল্পের,আঁকা-মানচিত্রের মধ্যে তুই কে?

এক রাত্তির জেগে ছেঁড়া কাঁথায় নকশা তুলেছিলি রাশ রাশ জুইঁ
কি সুন্দর,এসেছে শরৎ,গন্ধনাচনের দিন এলো,তবু তুই-

কার জন্যে কী?তুই রোদ্দুরে গেলেই আমার সর্বাঙ্গ বিদ্ধ হবে
অত্যন্ত না হলে আমার শরীর ক্রুসে সেঁটে গেঁথে লটকে দিস!

আমি বাঁচি,তুইও বাঁচিস,তোর জন্যে আমি,আমার জন্যে কী?
আকাশ তোর অরণ্যকুয়াশা ছাড়া কিছুই না,ধু ধু আর জল
আমার সন্দেহ,না তোর রগড়?

আগে তুই বেশ ছিলি,সোনার চেয়ে দামি মুক্ত আলো ফেলেছিলি-
আমার জন্যে বাজিয়েছিলি মিষ্টি অরগ্যান-আজ বিক্ষত হলাম।

শান্তির শত্রু,আক্রোশের ভ্রূণকে পুড়িয়ে খুন করবি,বেশ কর
এবং তোর ঈশ্বরের নাম বল।
আর পৌরুষপ্রাপ্তির আগে ক্ষিপ্ত অঙ্গারে জ্বলে যাই যাই পালাই
আর যদি না পালাই,বিন্দু হয়ে যদি না মিশি বিস্মৃতির গুহায়-

তুই আমার দেহে দুর্ধর্ষহিম মেঘকুয়াশার ভল্ল গিঁথে দিস!
আমার মৃত্যু তোর কি?আলোর গহীন থেকে তুই কি আঁকি দেখিস!



৩.পাঠক,অক্ষরগুলি

আমি বেশ কয়েকটি অক্ষরকে নিয়ে
সোনালি নস্যি রঙের ফ্রককোট পরে
বিষুবরেখার কয়েক ডিগ্রি ওপরে উঠেছি

বিটকেল শিক্ষার্থীসুলভ তাদের হাত
আঁচড়ের সাহায্যে আমাকে এমন ব্যবহার করছে
এবং আমার ছ'মিটার চওড়া দোলনের ওপর
তারা এমন ভারি নম্র অন্তহীন খেলা খেলছে
যে তাদের ত্রস্ত শঙ্কিত ঐক্যবদ্ধ নীলবর্ণের গ্রীবার ওপর
কপনি তুলতে হয়েছে

তারা আমার অন্তর্হিত যুক্তির ধাপ দিয়ে
নৈঋত ছায়ার পরিধি থেকে এসে
লবণের বরফখণ্ডের ওপর

তারপর তারা আমার কায়াহীন হাতের ওপর

আমি কোনো বীভৎস মুহূর্তে অক্ষরগুলির বোঝাও নামিয়ে নিয়েছি
তাদের মধ্যে কোথাও সৃজনীশক্তি লুকিয়ে আছে কিনা দেখবার জন্যে

অতি সুস্বাদু মাছ দিয়ে তাদের করেছিও বাতাস 

বস্তুত তাদের রূপসী হৃদয় রম্বস,বৃত্ত,সামন্তরিক গড়ন নিয়েছে

পাঠক,অক্ষরগুলি এলেমদার,উদ্যত এখন
একটু হেসে আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারছে
অসম্ভব উৎস থেকে বেরিয়ে এসে
মন্থর আশ্বস্ত পায়ে
অগোচর লক্ষ্যে হারিয়ে যেতে পারছে
আমার শাশ্বতের মূল টেনে আনতে পারছে 



৪.রাজনীতিবিদরা


রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে
রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে
প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে
রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমসমৃদ্ধ গ্রাম ও শহরের মানুষদের শেখায়
'নিতান্তই দলের একজন লোক'-তাদেরই দুর্দশার হেতু


যারা কোন শিশুদর্শকদের হয়ে ছবি আঁকে না
বা লাথিয়ে খামচে চেঁচিয়ে হাড় ভাঙবার যোগাড় করে না
রাজনীতিবিদরা সাধারণত তাদের উপর নির্ভর করে না
জনগণ নামক শ্রবণযন্ত্রে সাড়া জাগাবার উদ্দ্যেশ্যে
রাজনীতিবিদরা কাগজে বেতারে পাঠায়
দেশ স্বাধীনতা পৃথিবী মঙ্গল বিষয়ে বিষ-অভিজ্ঞতা


রাজনীতিবিদরা রচনা করে এখনও কারাগার
পশু-সংস্করণ,রাক্ষস খোক্কসের সৃষ্টি-রহস্যের আদিকান্ড

তারা আধা পুরোন সমাজের মায়াপঞ্জিকার ভেতরে এখনও লুকিয়ে থাকে



৫.মড়িঘর 

তিনি নিজের তৈরি কৃত্রিম বিষাদের ওপর এলেন,দেখলেন;
এই শীতল উদ্যমের দেশ,তার যা-কিছু ধ্রুব দান সঙ্গে যুক্ত হল।

প্রেক্ষক এক সুন্দর বিশ্লেষন চালিয়ে পুনর্বার আলোর চারধারে ভেসে চলল
এই বিশেষ দেয়ালে ঝোলান অস্বস্তিময় কঙ্কালেরা যন্ত্রের ঢিপি,বসুন্ধরার শৈবাল

চারিদিকে তড়িৎক্ষেত্র;যৌক্তিক দেহ যাত্রা শেষ করে
আসবে।সলজ্জভাবে সে নানাজনকে বাধা দেবে;মায়াময় তার সৃষ্টির শক্তির
একটিকে গতিশীল সেই সন্ধান কায়াটির সঙ্গে বাঁধল।

আমি শৌখিন,বরতরফ।আমার চারধার অতিপ্রোন্নত
পাবক সন্ধান করে কারুকার্য করা
বিশেষ রঙিন শান্ত পা-যা প্রাকৃত কীর্তির তলায়
প্রায়ই নিস্বপ্ন করে দেখায় গন্ধ,অনেক শোয়ানো শরীর আকণ্ঠ উন্মুখ
পরিবর্তন অভ্যর্থনা সৃষ্টি করে আকাশরশ্মির মতো
তার দৃষ্টিতে এমন সমস্ত চিত্র
উর্ধাকাশের বায়ুমণ্ডলের ওপর তার পতি কেঁপে উঠেছেন।

তার নিটোল নরম চোখে অদ্ভুত অক্ষর রয়েছে।সমস্ত নক্ষত্র আকাশ
ও ভ্রূণ বের করা দাঁত প্রসক্ত,আক্রান্ত।
বস্তুত,যখন শরীর ওপর-নিচ হয়ে প্রীয়মাণ গহ্বরে
পরিবর্তিত হয়,চোখের তারা স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছিটকোয়
তখন এসে দাঁড়ায় মেধাবিনী,সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়।

শস্যপ্রসূ বসুন্ধরা যার সামনে এসে অসাড় বোধ করলেন
তিনি স্পর্শ করা সৌন্দর্যের চাঁদ
তিনি চিৎ হয়ে,যেন আর তার কিছুই নেই-দেবী অদিতি তাকে
মাটি থেকে আকাশে তুললেন
এবং তার হৃদয় থেকে বেরুল উষার অবিশ্বাস্য-নিধি।

প্রেয়সী ঘরের একধারে এসে করলেন সহজব্রত
মাটিতে বসে সেই ছবি আঁকলেন,সমর্থ হলেন
সাজিয়ে দেওয়া সৌন্দর্যের ধারায় হংসযুগল
পুতুলের আকারের ওপর প্রাধান্য পেল
এবং সেই ভাস্কর্য রমণী,যিনি আমার জন্যে উদ্ভাবিত,তিনি এই হুবহু দেখলেন।



৬.আমার শত্রুদের জন্য
  
আমি আমার অগণিত শত্রুদের মধ্যে একা,সঙ্গীহীন।
আমি বস্তুত সেই শত্রুদেরই চিনি,যারা আমার বিকৃত গল্প নিয়ে
মাঝরাত্রি পর্যন্ত মেতে থাকেন

আমি,আমার শত্রুদের জন্য আমার তেজ ত্রিধা বিভক্ত করেছি।
এবং আমার হৃদয় বায়ুদ্বারা বর্ধিত হয়ে
তাদের সঙ্গে এখন বীরের মত যুদ্ধ করছে।

সেদিন এত বেশি ঝড়ের মতো হাওয়া বইছিল
যে,মনে হচ্ছিল আমি ও আমার শত্রুরা একই সঙ্গে মারা যাব
যেদিন আমি একটি উঁচু মাটির ঢিপির ওপর নরমুণ্ড সাজিয়ে
একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছিলাম।

বালক,বৃদ্ধ বা যেসব অনুচর,যারা এখনও
আমার শত্রুদের আজ্ঞাবহ হতে পারেনি
আমি তাদেরকে রত্নখচিত ছোরা,প্রাচীরবেষ্টিত ভূমি
এবং একটি করে গৃহ দান করেছি।
আমি শহর ছেড়ে দণ্ডকারণ্যের পথে
আমার শত্রুদের জন্যে এক বিশ্রামকেন্দ্র গড়েছি
পৃথিবীর যে সমস্ত দুর্গম স্থান কারুর দেখা হয়নি
তা আমি আমার শত্রুদের জন্যেই দেখেছি।

আমি বরফের দেওয়াল ঘেরা এক ছোট জায়গায়
আমার কয়েকজন শত্রুকে মৃতসঞ্জীবনী খাইয়েছিলাম।

আমি আমার শত্রুদের সৃষ্টিকর্তাকে দেখে পূত হয়েছি
আমার সমস্ত শত্রুরা তাদের সৃষ্টিকর্তার আজ্ঞায়
আমার মৃন্ময় রাস্তার ওপর এসে এখন দাঁড়িয়েছে।

আমার শত্রুরা পায়ে পায়ে পেছিয়ে গিয়ে
দ্রুত আমার ওপর তীর নিক্ষেপ করুক!




৭.প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না 


তুমি ঈশ্বরকন্যা,তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে
ব্যক্তিগত মৌলিক দৃশ্য থেকে ধূসর বিষয়ে আমি,ব্যক্ত অব্যক্তের
অবাস্তব মুহূর্তের স্বতন্ত্র আমি,আমার গভীরতর সাম্রাজ্যে
তুমি আছো,তুমি নেই
তোমার আশ্চর্য হবার মত বিশুদ্ধপ্রীতি,কৃত্রিম পদ্ধতিতে আকাশে
ওড়ার ব্যাপারে তুমি বয়সে প্রবীণ
তুমি ঈশ্বরকন্যা,অত মেহনত ও অর্থব্যয় পশু করে কেন ভেসে যাবে
যখন ধাবমান দিনে বস্তুপিণ্ড ও ধোয়াঁ-ঢাকা বরফ আবিষ্কার
তুষার ঝড়ে আমি নিজ-মর্ত্যসীমা চূর্ণ করে তোমারই জগতে প্রবেশ করেছি
সাদা অস্বচ্ছ ধোয়াঁ ও শৃগালের গুঞ্জরন নিয়ে
প্রলয়ের আকর্ষণীয় স্বচ্ছ পর্দার মত আন্দোলিত তরঙ্গে চলে গিয়ে
অন্য অনেক স্বপ্ন ভুলে তোমাকেই ভেবেছি
তুমি বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে এসেছো আপাত-অবাস্তব রং যেমন ঘুরে ঘুরে আসে
তুমি দুরত্বের ধারণা থেকে অতিনিপুনভাবে কখনো এসো না আর
আমি কি বয়সে নবীন?

প্রত্যহ শীর্ষকোণ ধরে আমি অন্য কতকগুলি জটিল যৌগিক পদার্থ
সৃষ্টি করে করে,গবেষক দেশে,আগের বারের মতই,হো হো
শুধুই ক্ষয়প্রাপ্ত ও স্নেহন
ঐ নিচে পৃথিবী থেকে এগিয়ে উদগীর্ণ গ্রহের পিঠ,পার্থিব প্রাণীর মত জিভ
যেন চিরকাল পূর্ণ,এই সার-সত্যের আভাস দাও
বিশ্রাম ক্যানভাস,বহো বহো,যখন পরমাণুশক্তি ও আধুনিক
রকেটের সাহায্য নিয়ে কোনোরকম না কোনো দুর্ঘটনা
যখন শব্দের চেয়ে সাড়ে দশগুণ বেশি দ্রুতগামী যাত্রিবিমান নির্মাণ
ও সেই অগ্নিসাগরের উর্মিমালা,শুক্র পরীক্ষা করে না এই সাগরের;
উপলদ্ধি জাগে,লম্বা দৌড়ের জন্য হারায় তার দুটি পা
যাকে সহজাত আলোকসম্পন্ন একমাত্র ঘুর্ণমান-নুড়ি বলে অনেকে মনে করে
পায় না গুণগত উৎকর্ষ ও নিরাপত্তা বা স্বর্গের মত শান্তির আবেগ


৮. বঙ্গদেশে টুপি 


বিশ শতকের গোড়ায় অজঅ বঙ্গালে টুপির সংস্কার ও টুপির প্রসারসংক্রান্ত 480 পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট বিখ্যাত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র উদ্ভবের সময় রিপোর্টের সবকটি পৃষ্ঠা ব্রিটিশ শক্তির হাতে চলে যায়। আমি বিধিসম্মতভাবে রিপোর্টটি উদ্ধার করে এনেছি আজ।
বঙ্গদেশ টুপি প্রদর্শক দেশ। এইদেশে সর্বাধিক বিক্রিত বস্তু টুপি।বঙ্গদেশে এর পরই বিক্রি মেষচর্মের ওপর লেখা টুপিবিষয়ে তথ্যপুস্তক।
সেই দেশের অধমাধম আবহমানকাল ধরেই টুপি পরে আসছে।তাদের টুপি পরার ইতিহাস 10,000 বছরের।তারা টুপিকে দেবতার দূত, অপদেবতা ও মানুষের মাঝে হিসেবে ধরে।এদের টুপিদেবতার নিম্নাংশে গাধা, উপরার্ধে ষাঁড়, সশ্মশ্রু, কৌতুকপ্রিয় তার মুখশ্রী,মাথার মস্তাকাবরণে মহিষের শিং।
মাত্র দুশতক আগে বঙ্গদেশে প্রথম ফ্যাশনদার টুপি প্রচলন করেন মেরী টেলার নামক এক মহিলা।তিনি টুপি বুনতেন স্টকিংস পদ্ধতি ডিজাইন 2×2 রিবং দিয়ে।সেই সময় এই দেশের মেয়েদের মাথায় মাংকি,কাউন্টি,স্কাল ক্যাপ;
কিস্তি, ফারা, পানামা, কাশ্মীরি, বর্মী টুপি ইত্যাদি পোশাকের শুধু কায়দাবাগিশ উপাদানই ছিল না,ছিল পোশাকের কৃতকীর্তি অঙ্গও।আর সব প্রদেশের সব বয়সের জন্য যথাযথ টুপি ব্যবহৃত হত।
উনিশশতকী বঙ্গদেশে বাঙ্গালিটুপি আ-মু-খৃ-দরদের প্রতীক বলে গণ্য হয়।
আর এই শতকেই বেঙ্গলি ক্যাপ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা পায়।এই কোম্পানির প্রকৃত মালিক স্কটল্যান্ডের আর্চিবন্ড।তার উদ্দ্যেশ্য ছিল এদেশের মহিলাদের উপযোগী টুপিনির্মাণ ও নির্মাণে সাহায্য করা এবং তা প্রদর্শন করা।তার কোম্পানি অনেকদিন সচল ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মাথার টুপি দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় বাস্কেটের খেলোয়াড়রা পোষা কাকেদের অন্যের টুপি ছিনিয়ে আনতে শিখিয়েছিল।দুর্ভাগ্যবশত কাকেদের এটা আর শেখানো হয়নি।তবে তারা টুপি ছিনিয়ে নিয়েই চলেছে।মজার ব্যাপার বঙ্গদেশের প্রত্যেকেরই মাথায় এক অদৃশ্য টুপি রয়েছে।আর এ শিল্পকলা ক্রমশ ঢাকা পড়ছে ক্র্যাশ হেলমেট আর ব্রেস্টপ্লেটে।আর হয়ে উঠেছে অপেক্ষাকৃত সরল গণতান্ত্রিক,আর একই সঙ্গে তার সহজাত রোম্যান্টিক বৈশিষ্ট্য বজায় থাকছে।
বঙ্গদেশের একো টুপির নতুন চিত্তাকর্ষক নমুনার প্রস্তাবও রেখেছেন আর্মামেন্ট রিসার্চ এস্টাব্লিশমেন্ট-এর শ্রীগেগং আপাং। তার তৈরি প্রতিটি টুপিতেই তিনটি কনডেনসর, একটি ট্রানসিস্টার ও একটি রয়েল থাকছেই।



৯.আমার সামনে,আমার চতুর্দিকে

আমার মুখ বিধুর আর ফ্যাকাসে,আমার সামনে
ভারশূন্য মরজীবন-অতিক্রমকারী চিরন্তন আমার আত্মা
আর আমার চতুর্দিকে শুকনো হাওয়া ভয়ংকর বৃষ্টি নিয়ে ঝুলছে


আমার শিকার করা মৃত-পাখিরা মেঝেতে ফুঁড়ে উঠতে চায় এবং গাঢ় হয়
নীল আর সবুজ রঙে আমি ঝলসে উঠি এবং ধাবিত হই


আমি পাষাণের মত স্থবির হয়ে থাকি
আমি আমার পেশল-রোমশ হাতে বন্যতার অমৃত বয়ে নিয়ে যাই
আমার শরীর থরথর করে কাঁপে
আর দূরের ভাসমান বাষ্পমেঘপুঞ্জের মতন ওড়ে


আমি এক আবেগে এক নতুন মানুষ হয়ে উঠেছি
এক গভীর পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে
আর আমার মন আমাকে গির্জে গাছ বাড়ি আকাশ ফুটো করে
দ্রুত গভীরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে


আমার পায়ের কাছে নগ্ন আকাশ,পায়ের কাছে নগ্ন আকাশ
আমি এই নগ্ন নীল আকাশের মত আকাশ কোথাও দেখিনি আগে
আমি চতুর্দিকের জ্যোত্স্নায় আর অন্ধকারের অস্পষ্টতায় শরীর ডুবিয়ে থাকি


আমার দৃষ্টির সীমার মধ্যে নীল আর সবুজ,সবুজ আর নীল
আমি এরকম মায়া-রঙ নীল সবুজের মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে পারি
আমি উপলদ্ধি করতে পারি নিজের সংজ্ঞা

আমি একজন স্বাধীন মানুষ
যা কিছু জীবন নয় তার সবটুকুকেই পরাভূত করতে পারি



১০.স্বাধীনতা ৫০
  
আমি গত ১০ বছর ধরে পৃথিবী বহির্ভূত এক সভ্যতার
প্রতিনিধিদের সঙ্গে আছি
আমার স্বপ্ন হল সমুদ্রের পাখিদের পুরিষ-যা এখানে এসে পড়ে

সম্প্রতি আমার কয়েকজন ভারতীয় স্থপতিবন্ধু
আমাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে:
ভারতবর্ষে আমাদের থেকে যেতে সহায়তা করুন
অবশ্যই এখানে গরম
ফল তরকারি অনেক
অর্থাৎ সেই সবজি যাতে আমরা অভ্যস্ত
কিন্তু এটা প্রধান নয়
এখানে আমরা সংঘবদ্ধ আছি


আমাদের উষ্ণ রাখে দশ ফিট উঁচু এবং চার ফিট
উঁচু এক টায়ার
আমাদের গুহাতেই পোষাপ্রাণীগুলোর গোয়াল
আমাদের কেমন তাপ ঝুলে আছে

আজও না-পাত্তা হয়ে রয়েছে ৫০,০০০ কোটি টাকার
সোনার বার-যা আপনাকে হিটলার
পাঠিয়েছিল অস্ত্র কেনার জন্য


১00 কোটি দশ লক্ষ লোকের শহর
প্লাস্টিকের আবর্জনায় জমে বেশ থমকে দাঁড়িয়ে আছে
প্রতিদিন ২৯,৩০,00,00,00 দৈনিকপত্র,৩0,00,00,00 রেডিও,টি.ভি সেট 100 কোটি
দশ লক্ষ লোকের কাছে খবর পৌঁছে দিচ্ছে


আমাদের স্বপ্ন হল প্রত্যেক গ্যারাজে একটি করে গাড়ি
এবং প্রত্যেক টেবিলে পালিশ করা ময়দার রুটি,
দুটি চিকেন

আপনি, আমাদের এখানে থেকে যেতে সহায়তা করুন


5 comments:

  1. অবিভক্ত মেদিনীপুরজেলার একপ্রথিতযশা কবি তথা পশ্চিমবঙ্গের একজন স্বনামধন্য কবি শম্ভু রক্ষিত একজন সত্যিকারের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কবি সুনীল মাইতির মন্তব্য-( উপর ও নিচের)
      ---- কবি শম্ভু রক্ষিত আমাদের আগামী দিনের সম্পদ।

      Delete
  2. উপরের দুটি মন্তব্য আমি না জেনে করেছি তারজন্য
    বিশেষ দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। --
    কবি সুনীল মাই।

    ReplyDelete
  3. আবার বলছি -কবি শম্ভু রক্ষিত সম্বন্ধে যে দুটি মন্তব্য না জেনে করেছি তার জন্য দুঃখিত এবং ভুল স্বীকার করছি।--কবি সুনীল মাইতি।

    ReplyDelete
  4. উপরের দুটি মন্তব্য আমি না জেনে করেছি তার জন্য দুঃখিত এবং ভুল স্বীকার করছি -- কবি সুনীল মাইতি।

    ReplyDelete