অমিতাভ- বিস্ময়ে আমার কঙ্কাল পর্যন্ত
কেঁপে যায়, যখন মনে হয় এই সময়ের কোনও তরুণ মহাভারতের গল্প নিয়ে কাব্যনাটক লিখছে
“কর্ণসারথী”। এমন কোন বিষয় মাথায় আসাটাই কি রীতিমতো অদ্ভুত নয়! আর সেটা লেখা হচ্ছে
ঐতিহ্যের সবটুকু মেনে!ভাবো সেই অংশটা, কৃষ্ণ যখন কর্ণকে বলছে-
“বুকের আগুন
আমি বুকে পুষে রেখে/প্রতিদিন পুরে যাব অত বোকা নই।বুকের আগুন আমি মস্তিস্কে
নিয়েছি।ব্যক্তির আগুন যদি সমাজে ছড়ায়/সমাজ সুফল পায় চিরকাল জেনো”। আর উত্তরে কর্ণ
বলছে- সাধারণ মানুষের দুঃখের কাহিনী?/ শুনে শুনে জনার্দন কান পচে গেল।/ জন্মে কেউ
শূদ্র কেন? কর্মে কেন নয়?/ সারথীর ছেলে শুধু সারথীই হবে!/ধনুকের অধিকার কেন সে
পাবে না!কেন কিছু ভীরু লোক জন্মের সুবাদে/অস্ত্রের দায়িত্ব নেবে কাঁপা কাঁপা
হাতে”- পড়তে পড়তে অনেক বছর আগে পড়া আন্তিগোনে নাটকের হিমন ও ক্রেয়নের
তীক্ষ্ণ,তীব্র,দ্যুতিময় সেই বাকযুদ্ধ মনে পড়ছিল।কিন্তু এটা বলতে চাইছিনা এখন। এই
সময়ের কোনো তরুণ কবি এমন চর্চিত কোন বিষয় নিয়ে এমন প্রথানুসারী ভাসায়(এমন ফালা
ফালা করে দেওয়া ধারালো যুক্তির প্রসঙ্গে যদি না ও আসি) এমন প্রাচীন আঙ্গিকে কিছু
লিখবেন-এই ভাবনাটাই আমার বিস্ময়ের।
অনুপম- (হাসি) লেনন, বায়েজ,
সিগার-এদের গান শোনেন এখনও?
অমিতাভ- (হাসি)লাভ নেই
অনুপম! একটা কথা বলি। আমার এই কথাগুলো
কিন্তু পত্রিকা থেকে বাদ দেবে না। “কর্ণ”- তোমার বিশাল একটা কাজ। আমার মনে হয়
তোমার দিন ছিয়ানব্বই ঘন্টার। নাহলে এতো লেখা সম্ভব না। “আলেফ”, “কর্ণ”, সাথে হাজার
রকমের দেশ-বিদেশের নিয়ে অমন মেধাবী লেখা- সময় পাও কী করে!
অনুপম- এবার তো থামবেন। প্রশংসা আর
নিন্দা, দুটোই সামনাসামনি নিতে পারি না।
অমিতাভ- “কবিসম্মেলন”এ এই মাসের কবি
বেবী সাউ। ভালো কবিতা। বেবী সাউ-এর একটি বই আমার কাছে আছে। “ গান লেখে লালন দুহিতা”।
কবিসম্মেলন জানিয়েছে ওর জন্ম ১৯৮৯। ২০১৭ সালের তিন মাসের মধ্যে লেখা আটান্নটা সনেট
আছে বইতে।ছন্দোবদ্ধ অন্ত্যমিল দেওয়া কবিতাই শুধু যদি লিখতো,বেবী যদি এর বাইরে
বেরোতো না,তার মূল্যায়ন হত অন্য মাত্রায়।কিন্তু তেমন তো নয়!কিসের মুখোমুখি হতে এবং
কোন্ জয় প্রতিষ্ঠা করতে!বছর চল্লিশ আগে জয় গোস্বামী, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল এবং
আরও কেউ কেউ কামড়ে খেয়ে ফেলেছিলেন এই ফরমকে। অনেক বছর পর, আমি, সনেট ঠাসা একটা বই
পেলাম। একটা পড়ে দেখা যাক-
কফিনে শহর
ভাসে মৃতদেহ ক্ষুধিত পাষাণ
সমস্ত পথের
বাঁকে ভূতচিহ্ন নরকযাতনা
মৃতের শরীর
নিয়ে শহর মেতেছে ব্যান্ড গান
নিষাদের
জন্মশোক পাখিহত্যা এ পরিকল্পনা
শকুন ঢুকছে
ঘরে হাত পায়ে ঘামরক্তজল
ঠোঁটে তার
লোলচিহ্ন, পাথরের অস্পষ্ট কলঙ্ক
মাংসলোভী
প্রাণী এই নখে লেগে গহ্বর অতল
আঁশগন্ধ
বুকে ভাসে, গমশীষ রাতের পালঙ্ক
শকুন আসলে
শোক, শিকারীর।বুঝেছিল যারা
পালক পোড়াতে
চেয়ে, শীত রাতে নিবিড় উষ্ণতা
রাতকেই
অন্ধকার ভাবে অজুহাত ছলসুতা
বোধন চায়নি
তারা, মৃত্যু ভেবে কলাগাছ পাতা
বানানো কফিন
ঘিরে, মৃত পিপীলিকা সারিসারি
মৃত্যু তো
শান্তির নামে, উপাসনা পেতেছি তো তোরই
কবিতাটি
পড়তে পড়তে গণেশ পাইনের ছবি- মৃত্যু, বিষাদ ও আলো অন্ধকারের চিত্রকর-মনে
পরে।অনুজ্জ্বল অশুভ হলুদ আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের রঙে যেন কবিতাটি বোনা। “দ্য
হ্যান্ড” নামের ছবির কথাই প্রথম মনে হয়েছিল,যখন কবিতাটি পড়ি। ট্রাউজার পরা একজন
পুরুষের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ছবি। ডান হাতটি অদৃশ্য।হয়তো পকেটে ঢোকানো।দাঁড়ানোর
জোরালো ভঙ্গিতে ঔদ্ধত্য আর স্পর্ধা। যেন কালো কাচ ঢাকা গাড়ি। বা হাতটি যেন এই
শরীরের কেউ নয়।নিস্ক্রিয়,নিস্পৃহ উদাসীন- ঝুলে আছে শূন্য থেকে। যেন মৃতের হাত কোন।
পাথরের কয়েকটা অংশ পেট ও ঊরুর মাংসে ঢুকে আছে। দুটি হাত যেন জীবন ও মৃত্যুর
প্রতিমা। এক বোবা অন্ধকার যেন আস্তে আস্তে ঢেকে দিচ্ছে সব কিছু।বেবী সাউ এর বইটিতে
এই অশুভতা, এই evil report আছে। কবিতা সবসময়
বেনোজলকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে। আমার শ্রদ্ধা হয় যখন দেখি সহজ রাস্তা ছেড়ে কেউ কেউ
দুর্গম, ব্যর্থতাময় রাস্তা নিচ্ছেন। গ্রাফিক্সের যুগে যদি কাউকে প্রায়ান্ধকার ঘরে
উপুড় হয়ে একমনে কাঠখোদাই বা পাথরছাপের কাজ করে যেতে দেখি তার সেই সাধনাকে আমার
সশ্রদ্ধ কুর্ণিশ, তার এই আত্মসন্ধানকে।
অনুপম- দান্তেকে নিয়ে সবসময় উচ্ছ্বাস
দেখেছি আপনার। বিশেষ করে ইনফার্নো আর পারগে তুরিও নিয়ে। দান্তে কি সুদূর কোনো
নক্ষত্র হয়ে যাননি এখনও? অতটা পিছিয়ে গেলে কি আপনি সময় থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন না?
অমিতাভ- দান্তে সবার ঈশ্বর। একজন
প্রধানতম শক্তিশালী দেবতা যিনি স্বর্গ থেকে পথ দেখাতে আসেন কবিদের। এক উঁচু
পাহাড়ের অপরিমেয়তার সামনে আমি পিঁপড়ের মতো দাঁড়িয়ে। পিঁপড়ে কি কোনোদিন সেই পাহাড়ের
বিশালতা? এলিয়টের কবিতা(এখন তো রীতিমতো প্রাচীন বলা যায় তাঁকে।“ওয়েস্টল্যান্ড” ই তো
একশো বছর ছুঁতে চললো) একটা রহস্যময় চাবির গোছা তুলে দেয় আমার হাতে বাইশ বছর
বয়সে।সেই ছাবি ব্যাবহারে এলো ১৯৯০ নাগাদ।ফ্রেজারের “গোল্ডেন বাউ”,সাথে
ফ্রয়েড,ইয়ু্ং,অ্যাডলার টুকটাক পড়তে পেলাম।
আর ফ্রানৎজ
কাফকা-পাগল করে দেওয়া কাফকা।নিজে আইনশাস্ত্রের মেধাবী ছাত্র ছিলেন-তাই আইনের
নির্দয় নিঃস্পৃহ মুখ, তার ভয় জাগানো উপস্থিতি, তার অবাস্তবতা তাঁর অজানা ছিল না।
চাকরির জন্য যখন আমাকে অন্যায় ও দণ্ডবিষয়ে খোঁজ রাখতে হত,আমার মনে হতো আমি যেন
একটু আধটু ধরতে পারছি কাফকা কে।কাফকার এই পৃথিবীর সাথে দান্তেও যেন মিলে যান
কোথাও।“ইনফার্নো”য় শেষ দিকে এসেছে উগোলিনোর গল্প।কাউন্ট উগোলিনো আর তার চার
সন্তানকে চোরাকুটুরিতে পেরেক এঁটে দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে শাস্তি দিয়েছিল
আর্চবিশপ রাগিয়েরি।সরু ফাটল দিয়ে কয়েকমুহূর্তের জন্য শীর্ণ চাঁদের আলো ঢুকছে সেই
চোরাকুটুরির মধ্যে আর অনাহারে, যন্ত্রণায় অন্ধ উগোলিনো তার চার সন্তানের মৃতদেহ
হাতড়ে খুজছে।কাফকা ও কি অতিকৃত এই ইনফার্নোই কি দেখান নি আমাদের? গলায় ছুরি বসার
মুহূর্তে জোসেফ কে রুখেছিল মুহুর্তের জন্য খুলে যেতে এক আলোকিত জানলা। জোসেফ কে কি
খুব দূরে উগোলিনোর থেকে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুখ্যাত “আউসউইটজ” ক্যাম্পে
কাফকার ছোট্ট তিন বোনকে মেরে ফেলা হএছিল।পায়ের জুতো আর অন্য কিছু দিয়ে চেনা
গিয়েছিল তাদের।কাফকা কি অনেক দূরে উগোলিনো থেকে?ইহুদিদের রক্তের দোষ “আবিষ্কার”
করে যে বর্বরতায় হিটলার ইহুদি জাতিকেই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আর্চবিশপ রাগিয়েরি
ইনফার্নোয় সেটা করেন নি? জীবন কোথায় কীভাবে এক সমান যন্ত্রণার হননভূমিতে নিয়ে
যায়!প্রথম যেদিন রক্তবমি শুরু হল কাফকার,তিনি বুঝলেন তাঁর আসন্ন অবসানকে। জানলেন
তাঁর মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা।তিনি দেখলেন যেন শৈশবে ফিরে গেছেন তিনি তাঁর মায়ের
স্কার্ট ধরে নিরাপত্তা ও আশ্বাসের বলয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
অনুপম- এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। পাঁচটা
ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চোখের ভূমিকাই কবিতার সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। কবির দেখা। জীবনানন্দ
দাশের চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ওখানেই তাঁর কবিতার সারাৎসার। মনে হয় না আপনার,
একজন কবিকে অন্ধ করে দিলে তাঁর কবিতা শেষ হয়ে যাবে? শকুন এসে তাঁর দেহের সকল মাংস
খেয়ে যাক, কিন্তু চোখ যেন না খায়, এই মঙ্গলকামনাই কি আমরা করি না একজন প্রকৃত কবির
ক্ষেত্রে? আপনার কবিতায় অবিশ্যি দেখার চেয়ে ভুল দেখা কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি
ঠিক দেখা বলে কিছু থাকে, তার সামনে নত হতে আমার আপত্তি নেই। হা হা হা হা...
অমিতাভ- অথবা যেন ড্রয়িং ক্লাসে কিছু
আঁকতে বলা হয়েছে। সময় ফুরিয়ে আসছে কিন্তু আমি পৌঁছতে পারছিনা কোন সিদ্ধান্তে। একটু
নৌকা, খানিকটা সূর্যমুখী ফুল আর আধখানা গাছ আঁকা ড্রয়িংশিট যেন নিয়ে ছলে গেলেন কোন
পরীক্ষক। ছোটবেলায় স্বপ্নে একবার দেখেছিলাম আমি একটা কাঠবেড়ালি হয়ে গেছি।সারাদিন
খুবই চিন্তার ঘোরে ছিলাম স্বপ্নটা দেখে।বুঝতে পারছিলাম না,আসলে আমি কি নিজেই সেই
কাঠবেড়ালি যে আমার স্বপ্ন দেখছে,না আমিই কাঠবেড়ালিকে স্বপ্নে দেখেছি।স্বপ্নটা কার
তার ওপর গোটা বাস্তবটা দাঁড়িয়ে।
অনুপম- আজকের কবিতা তো সিনেমা থেকেও মুখ ফেরাতে পারে না। সিনেমা- সেই শিল্পমাধ্যম যা
আজ অন্য সবাইকে ডুবিয়ে দিয়েছে, জনগ্রাহ্যতায়। একটা সিনেমা তার দর্শককে যা দিতে
পারে, একটা কবিতাও কি পারে না? সিনেমার কাছে কোনো ধার না ধেরে? এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
আমি নিজে এই চ্যালেঞ্জ ফিল করি। আপনার কবিতাতেও এটা আছে।
অমিতাভ- সিনেমা বর্তমান যুগের সবথেকে জোরালো ভাষা।আমাদের নিজস্ব প্রাপক-প্রান্তের উপযোগী হয়ে যা আসে,তার সংবেদন আমাদের কোন অতলে যে চলে যেতে পারে
আমরা নিজেরাই তা জানি না। ব্যথার বিজ্ঞাপনে “আউচ” বলে কাৎরে ওঠা এখন আমাদের জীবনেও
চলে এসেছে।
অনুপম- জীবন বহির্ভূত কি
সেই আউচ? যা কিছু বিদেশি, তারও তো দেশ আছে। সেখানে চলে যাওয়া যায়। কখনও কখনও
পাসপোর্ট লাগে না। প্রশ্নটা কিন্তু ছিল আপনার কবিতা নিয়ে। অনেকের কাছেই আপনার
কবিতা তীব্র বিদেশ।
অমিতাভ- সেই রাস্তাই তো
ধরবো। জুতোর ফিতে বাঁধতে হবে না!
অনুপম- (হাসি)
অমিতাভ- কাঠবেড়ালি নয়। আসলে আমি ক্যামেরাই হয়তো। ক্যামেরা তো নিজেকে দেখায় না।আমার
কবিতার মধ্যেও আমি নিজে কোথাও নেই।অস্পষ্ট একটা হাত-কার হাত জানিনা আমি- ব্যবহার
করছে আমাকে। “ব্লো আপ”এর টমাসের মতো কেউ একজন আমাকে “অন্” করে ঝোপের মধ্যে বসিয়ে
রেখে গেছে। ক্যামেরা যেমন নিজে কিছু বিশ্লেষণ করেনা,ব্যাখা করেনা, শুধু দেখায়-আমার
কবিতায় ও তেমনি আমি কোথাও নেই।“আমি” শব্দটা হয়তো এসেছে- কিন্তু সেটা অন্য কারো আমি, যে আড়াল থেকে কথা বলছে কখনও ম্যাডাম এম,কখনও ক্রিস্টোফার,কখনও
হেনরি,কখনও মায়েস্ত্রোর সাথে।তাদের পর্যালোচনা করছে, সতর্ক করে দিচ্ছে, উদ্ধারের
ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অনুপম- এছাড়াও আপনার কবিতায় কিন্তু
মাঝেমাঝেই সিনেমার দৃশ্যের একটা ফ্লেভার চলে আসে, বেশ জোরালোভাবেই। আপনি কি টের পান এটা? সিনেমার নিষ্ঠ দর্শক বুঝে নেবে, আপনি
কোন ফ্রেম থেকে নিচ্ছেন, কোন জায়গায় কাটছেন।
অমিতাভ- জানি। জেনেশুনেই তো
করা। টোটেম ভোজ এ “রশোমন”, “দ্য ড্রিম” (বিশেষ করে বরফ ঝড়ের অভিযাত্রীদের অংশটি),
“টিনড্রাম”, “দ্য সেভেন্থ সিল”, “ব্লো আপ”, “সাইলেন্স”, “ব্রিদলেস” কোথাও সরাসরি
কোথাও একটু মুখ লুকিয়ে এসেছে। “টোটেম ভোজ” এ “প্রথম পাপাবরণ পরিত্যাগ” এ ‘রশোমন’
এর দস্যু তোজোমারুর (অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তোসিরো মিফুনে)ভার্সনে হত্যাকান্ডটির
বর্ণনা চলে এসেছে। সেটা তেমন না খুঁজেও পাওয়া যায়।যেমন “প্রথম ভোজ ঃঅভিশাপের আগে”
(টোটেম) কবিতাটিতে ১৯৯৭-৯৮সালে সাদাকালো অ্যানিমেশনের বিজ্ঞাপনে দেখা দেয়ালের মতো
মুখের চারজনের নড়াচড়া একদম সরাসরি এনেছিলাম মজা হিসেবে।
একটা
অন্যরকম মজাও আছে আরেকটা কবিতায়।“মোড় আর বৃষ্টিগাছ”নামের একটা কবিতায় নির্দিষ্ট
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ রোজ সময়কে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার খেলার মধ্যে নিজের
জন্য গোপনে মজা খুঁজে নেয়। ক্যামেরায় রিউইন্ড করার সময় সে যেন দেখে ওষুধের দোকান
থেকে একজন মহিলা হাসতে হাসতে পিছিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির চাকার নিচ থেকে রক্তাক্ত একজন
মানুষ উঠে দাঁড়াচ্ছে আবার। আসলে লোকটা রোজ তার নিজস্ব ধরনে সময়কে বিপরীত গতিতে
নিয়ে যাচ্ছে এভাবে। এরকম আরেকটি লেখার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে “ যে বাড়িতে দরজা
নেই”। কোথাও দরজা নেই,তবু একজন মানুষ বাতাসে আঙুল দিয়ে দরজা আঁকে। বাতাস তখন সত্যি
সত্যি জমে যায়, আর দরজা হয়ে ওঠে। টোকা দেয় সেই দরজায়, নিচু গলায় যেন বলে ওঠে “আসতে
পারি?” যা বাস্তবে নেই সেটাই এবার বাস্তব হয়ে উঠেছে। বাতাস দিয়ে বানানো দরজায় শোনা
যাচ্ছে টোকা দেওয়ার আওয়াজ। বাতাস সত্যিই দরজা হয়ে উঠছে। আন্তোনিওনির “ব্লো আপ”
ছবিটি আমাকে ভূতগ্রস্ত করে রেখেছিল। যখন ঘাটালে থাকতাম, তোমার আর আমার দু’বছরের
নিত্যদিনের রাতের আড্ডায় এই সিনেমাটির কথা এসেছিল কিনা।
অনুপম- মনে নেই। আজ থেকে
এক যুগ আগে শীতের সন্ধ্যায়, বা ঝড়ের বিকালে, অজস্র বিষয়ে আমরা কথা বলতাম তখন। হয়তো
এসেছে তার মধ্যে। কবিতা আর সূর্যের নীচে যা কিছু নড়েচড়ে ওঠে, সবকিছুই আসত সেই
আড্ডায়। শুধু নিজেদের কবিতা পড়ার ব্যাপারটা নিষিদ্ধ করেছিলাম আমরা সেখানে। যাইহোক
আপনি ‘ব্লো আপ’ নিয়ে একটা কিছু বলছিলেন যেটা শেষ হয়নি এখনও। ওই সিনেমার লাস্ট সিনটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে
জীবনভর। বলহীন টেনিস? মৃতদেহহীন হত্যারহস্যের মতো।
অমিতাভ- হ্যাঁ। খেই হারিয়ে যায় মাঝে মাঝে।ব্লো আপ। ঝোপের মধ্যে রাখা ক্যামেরা একটি
হত্যাদৃশ্য ধরে রাখে। কিন্তু বাস্তবে সেই
খুনের ট্রেস কোথাও নেই। এর উল্টোদিকে রয়েছে এক টেনিস খেলার দৃশ্য। টেনিস খেলা চলছে
রাত্রিবেলায়। দর্শকরা নিবিষ্ট হয়ে দেখছে সেই খেলা। কিন্তু কোথাও বল নেই। যেন
শ্যাডো গেম। বল আর র্যাকেটের সংস্পর্শের শব্দও নেই।
অনুপম- তারপর টমাস হঠাৎ
খেয়াল করে সবাই তার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে...যেমন এ মুহূর্তে আপনি তাকিয়ে আছেন আমার
দিকে। হা হা হা হা... বলটা যেন হঠাৎ টমাসের পায়ের কাছে চলে এসেছে, আর সবাই আশা
করছে টমাস তুলে নিক বলটি। ছুঁড়ে দিক খেলার মধ্যে।
অমিতাভ- টমাস সেই অদৃশ্য বল তুলে নেয়, ছুঁড়ে দেয় খেলার মধ্যে। সে অংশগ্রহণ করে এভাবে। খেলার সাথে জড়িয়ে যায়। আর এবার তার কাছে আস্তে আস্তে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই বল। র্যাকেট আর বলের পক পক শব্দ পর্যন্ত তখন কানে আসে তার। দারুণ লাগে এই কাল্পনিক বল ছুঁড়ে দিয়ে তাকে বাস্তব একটা অস্তিত্ব দেওয়ার ব্যাপারটা। যা নেই তাকে আছে বলে মনে করতে হবে। আর তখনই রিয়েলিটিকে অনুভব করা যাবে। বেশি সিনেমা তো আমি দেখিনি। জানিও খুব কম। আমার দেখার চোখ একার হাতে বদলে দিয়েছিল ‘ব্লো আপ’।
আমার তো
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা ক্যামেরা ছাড়া আর কিছু না। ঝোপের মধ্যে পড়ে থাকা একটা
ক্যামেরা আমার নামে হয়তো যার ব্র্যান্ড নাম!(হাসি)
অনুপম- হাঃ হাঃ হাঃ! এটা কি ক্যামেরা হয়ে ওঠার শর্ত নয়? আমার তো মনে হয় এই সিমুলেটেড পৃথিবীতে ক্যামেরাগুলো একদিন মানুষের চেয়ে বেশি কথা বলবে। ক্যামেরা হয়ে ওঠা মানুষদের নিয়ে হলিউড কেন ইন্টারেস্টেড নয় কে জানে! খুব রোমহর্ষক মুভি বানানো যেতে পারে।
অমিতাভ- একভাবে আমরা সবাই তো এক মায়া-জীবনের মধ্যে র্যাকেট হাতে শূন্যতার মোকাবিলা করছি।“মায়া” শব্দটা মনে পড়লো “মায়াজন্ম”- সেলিম মণ্ডলের কবিতার বই। নিজের কবিতা-বই প্রথম দেখার শিহরণে চাপড়া থেকে কলকাতা বইমেলা যাওয়ার সময় সেলিম সবাইকে ফেসবুকে জানায় সে তার নবজাতককে দেখতে যাচ্ছে। অনেকে অভিনন্দন জানায় সন্তানের পিতা হওয়ার জন্য। এই উচ্ছ্বাস তো দিব্ব্যোন্মাদ কবিদেরই হতে পারে। আমার খুব ভালো লেগেছিল এই উচ্ছ্বাস, অনুপম। তোমার প্রথম কবিতার বই অনেক বছর আগে যখন বাংলা একাডেমীর লিটল ম্যাগাজিন মেলায় দিয়েছিলে আমাকে, প্রসন্ন, আত্মবিশ্বাসী হাসি ছিল তোমার মুখে।
অনুপম- অনেকদিন পর আবার সেদিন দেখা হয়েছিল আমাদের। প্রসন্ন ছিলাম কি সত্যিই? প্রসন্নতা হয়ত আমার জীবনে নেই।
অমিতাভ- হ্যাঁ। অনেক কবি তাদের নতুন নতুন ছবি পোস্ট করেন নানা সাহিত্যসভায়/ সম্মানপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতির। সেলিমের পোস্টগুলো ছিল তার চারপাশের জীবনের। দোকান, পুকুর, গাছপালা... আর পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলার যেখানে ও নিজে খেলে নিয়মিত। আমার খুব ভালো লেগেছিল এটা। ওর কবিতার মধ্যেও সরাসরি ঢুকে যায়। ওর “ মায়াজন্ম” বই থেকে একটা কবিতার শেষ চারটে লাইন পড়া যাক- কবিতার নাম “খেলা”- “ নিজেকে নিয়ে খেলতে খেলতে নিজের ভিতর যে মাঠ/ যেখানে পায়ের ছাপ আছে,গোল আছে, শূন্য আছে/ কোনও গোল পোস্ট নেই/একটা ফুটবলের মতো পৃথিবী একা একা খালি হাসছে”
- এও তো একধরণের ব্লো আপ, কবির ভেতরের শূন্যতা মিশে যাচ্ছে
বাইরের দুর্বোধ্য পৃথিবীর হাসির সাথে। আরো একটু পড়া যাক সেলিম কে-
বাবা ও অশ্বত্থ গাছ
প্রত্যেকটা দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে
একটা গাছ থাকে
অশ্বত্থ গাছ।বাবার মতো...
যা বংশানুক্রমিক জড়িয়ে নেয় বীজ
ঢেলে
বাবা চোলাই কাঠের খদ্দের হয়ে
একটু একটু কুড়িয়ে নেয় শুকনো
ডালপালা
সময় নিজেই ভুলে যায়- গাছ বড় হলে
কীভাবে ভালোবেসে ফেলে একটা
আধভাঙ্গা উনুন
এবার আরেকটা কবিতা-
মুনাই ও অশ্বত্থ গাছ
মুনাই নামে আর কোনও অশ্বত্থগাছ
থাকতে পারে না
আমি নিতান্তই বোকা
হাফপ্যান্ট পেরোনো ছেলেমানুষ
ছায়া সম্পর্কে আমাকে যারা
মহাভারত শোনায়
আমি তাদের ঝুরি ধরে ঝুলতে
দেখেছি
ওরা ভুলে যায় বট আর অশ্বত্থের
মধ্যে ফারাক
ওরা মান্ধাতার আমল থেকে বড় বেশি
ধর্মপিপাসু
আমি ওদেরই পুনঃজন্ম চেয়েছি
মুনাইয়ের একশ বছর পেরোনো ছায়ার
তলে
চাপড়া থেকে
কৃষ্ণনগরের ১৮ কি.মি দূরত্ব এই মুহূর্তে মুছে গেল যেন। আমার মনে পড়লো বাংলা কবিতার
এক নির্মোহ, সম্ভ্রম জাগানো কবি দেবদাস আচার্য আর তাঁর অসামান্য “ মানুষের
মুর্তি”র কবিতাগুলি যেখানে এসেছে বাবার ফুলে ওঠা শিরা, হাটে পসরা নিয়ে সারাদিন
রোদে বসে থাকা বাবার জন্য মায়ের উদ্বেগ, নিকিরি পাড়ার মোরগ, দূর থেকে ভারী পসরা
নিয়ে গাঢ় সন্ধ্যায় দূর থেকে বাবাকে ফিরতে দেখার স্বস্তি। অনুপম, দেবদাস আচার্য
কাঁপিয়ে দিতেন আমাকে। ৩৫ বছর আগে ওঁর ঘূর্ণির অফিসে প্রথম দেখা করতে গিয়ে
বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে সবার সামনে আমি “মানুষের মূর্তি” বইটির সব কবিতা আমি মুখস্থ
বলতে শুরু করি। অন্তর্মুখী দেবদাস আচার্য খুবই অপ্রস্তুত হয়ে অফিসের কাছেই ওঁর
বাড়িতে নিয়ে যান এবং ছেঁড়া খোঁড়া “ মৃত শকট” আর “কালক্রম ও প্রতিধন্নি”র পড়ে থাকা
শেষ কপিটি আমাকে দিয়ে দেন। সেলিমের কবিতা আমাকে দেবদাসদার কবিতা মনে পড়ায় “মানুষের
মূর্তি”র ব্লার্ব আজও আমার মুখস্থ। শেয়ার করি?-
“ জীবন
আমাকে যা দেয় তার বেশি কিছু জীবনকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনা। শুধু এইটুকুই আমি
পারি। এর বেশি কোনো অঙ্গিকার আমি করিনি” জানিনা মনে মনে সেলিম ও হয়তো এরকম কিছু
ভাবে।
অনুপম- দেবদাস আচার্য একজন আত্মস্থ
মানুষ এবং কবিতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা পৃথিবী বানিয়েছেন। ঘাটালে একদিন আপনি বলেছিলেন ২০০০ সালের বন্যায় ওঁর বাড়ির ঢালু রাস্তা প্রায় সাঁতরে আপনি
দেখা করতে গেছিলেন আর বারবার উনি আত্মবিস্মৃতের মতো বলে যাচ্ছিলেন মালদায়
বিদ্দুৎদপ্তরের আবাসনে আরটি সেট হাতে রাত জেগে ওঁর ছেলের কাজ করে যাবার কথা। এই
অভিজ্ঞতাগুলো আপনি বুকে লালন করেন। সেগুলো ধীরে ধীরে কাল্পনিক অভিজ্ঞতার বলয়ে ঢুকে
যেতে থাকে। সেখানে দেবদাস আচার্যের পৃথিবী আর অমিতাভ মৈত্রের পৃথিবী ওভারল্যাপ
করে। আমি তাদের একে অন্যের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার শব্দটা টের পাই।
অমিতাভ- বাহ! তোমার মনে আছে!
অনুপম- হাঃ হাঃ। মনে রাখার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলব না। আপনার
স্মৃতিশক্তি আমাকে অবাক করে দ্যায়। এত মনে রাখতে পারার সুখ আর অসুখ নিয়েও কথা বলব
আপনার সঙ্গে।
অমিতাভ- শুধু স্মৃতি? তার
বাইরে কিছু নেই? একটা কবিতার বই খুব ভালো লাগল অনুপম। কবি অশোক ঘোড়ই বইটি
পাঠিয়েছেন।“ নাইন্থ সিম্ফনি”। বইটি পড়ে আমি চমৎকৃত। সারা বইটি জুড়ে অশোক যেন খুব
ধীরগতিতে একটা শীতল, নিষ্প্রাণতার ঘোর তৈরি করেছেন।বারবার ঘুরে ঘুরে এসেছে এক
অদ্ভুত রাত্রিময় পৃথিবীর টুকরো টুকরো ছবি। বাঁকে বাঁকে চমক অপেক্ষা করেনা এমন
কবিতায়, বরং মনে হয় একটা নিচু সুর যেন গেঁথে দিচ্ছে প্রতিটি কবিতাকে মসৃণভাবে। অনুচ্চকিত, ঠাণ্ডা,
ছায়াঢাকা শব্দগুলো যেন নিজেরাই চোখভর্তি ঘুম নিয়ে সমাধিভূমির দরজা খুলে দিতে আসছে
তোমাকে।পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো যেন প্যাপিরাস হয়ে উঠছে আর আমি
পড়ছি ১৫০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের “The book of The dead” যখন প্রধান দেবতা হিসেবে মৃত্যু পরিচালনা করছেন ওসিরিস। গোটা বইটা যেন একজন
কথকের টুকরো টুকরো দৃশ্য-অনুভূতির বর্ণনায় গাঁথা। একজন চরিত্র- “ সে” অনির্দিষ্ট পরিচয় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়
এক দেশ থেকে অন্য দেশে, রাত্রির মতো।
অনুপম- “I pass like night from land to land”? (হাসি)
অমিতাভ- ঠিক। (হাসি)
অনুপম- অমিতাভদা কোলরিজ সম্পর্কে
কী মনে হয়? ‘রাইম অব দ্য অ্যানসিয়েন্ট ম্যারিনার’-এর মতো কবিতা পৃথিবীতে আর লেখা
হয়েছে কি? ‘কুবলা খাঁ’? আমরা দান্তেকে নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। আমার কোলরিজ মনে
এল। পাপবোধকে এভাবে ব্যাখ্যা আর কেউ করেছেন কি? মনে হয় না। সমুদ্রের বুকে অনন্ত
জলরাশির মধ্যে যে তৃষ্ণা জেগে থাকে, পুড়িয়ে খাক্ করে দিতে থাকে...
অমিতাভ- একদম। বোদলেয়র এর
দুর্ভাগ্য যে উনি অ্যালান পো পড়েই মুগ্ধ হলেন, কোলরিজের লেখা পড়াই হলোনা ওঁর।
কামুর “বুট হ্যাট কোটে”র পতনশীল নায়কেরা কোনো না কোনোভাবে গলায় অ্যালবাট্রস ঝোলানো
নাবিকের ঝাঁ চকচকে রেপ্লিকা। শুধু একটু বেশি বুদ্ধিমান, আদব কায়দা জানা প্রতারক।
অনুপম- একদম আমার মনের কথা
বললেন। একজন ভারতীয় হিসেবে যখন বদল্যের বা কাম্যুকে পড়তে যাই, কোথাও একটা
অপ্রাপ্তির অনুভূতি ছেয়ে ফেলতে থাকে সেই পাঠ। ওঁরা নিজেরাই তো অ্যালবাট্রস গলায়
ঝুলিয়ে বসে আছেন! কোলরিজকে নিয়ে আমার মুগ্ধতার সীমা নেই। আপনি কাম্যুর কথা বললেন।
কাফকাও কি নন? যে লোকটা পোকা হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠে, তার গলাতেও কি ঝুলছে না
অ্যালবাট্রস? তবু, কাফকা একরকম বেঁচে গেছেন অমরত্বের পথে। কাম্যুর কিন্তু তারিখ
আছে।
অমিতাভ- জানো অনুপম, অশোক ঘোড়ই এর “ নাইন্থ সিম্ফনি” বইটির প্রোটাগনিষ্ট যেন মৃত্যুর দেশে,
ও সিরিসের দেশে ঘুরে বেড়ানো মৃত আত্মা (কা)যে সবকিছু দেখে। আর তার ছায়াসঙ্গী হয়ে পাশে আছেন কবি।
মৃত্যুর দেশে
প্রবেশের আগে মৃত আত্মাকে দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্ব পার হয়ে তবে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। আমি কি ছোট্ট একটা অংশ
বলবো?
অনুপম- কেন নয়!
অমিতাভ- বেশ বলছি। “কা”
আমাকে রেগে গিয়ে ধরে ফেললে তুমি নিশ্চয় বাঁচাবে?
অনুপম- বলুন…
অমিতাভ- একের পর এক দেবতা আসছেন আর প্রশ্ন করছেন মৃত আত্মাকে। ব্যাপারটা এই।
- যেতে দেব না তোমাকে যদি না আমার নাম বলতে পারো তুমি। বলে
ওঠে মৃত্যু- দেশের দরজা
- সত্য ও শাশ্বতের প্রকাশ তুমি। ভর তুমি।
- যেতে দেব না তোমাকে যদি না তোমার নাম বল তুমি। বলে ওঠে
ডানপাশের খুঁটি।
- সত্য ও শাশ্বতের শ্রম তুমি। তুমিই ভর।
- যেতে দেব না তোমাকে যদি না আমার নাম বলতে পারো তুমি। বলে
ওঠে বাঁপাশের খুঁটি।
- বস্তুর বিচার তোমার নাম।
- যেতে দেব না তোমাকে যদি না আমার নাম বলতে পারো তুমি।বলে ওঠে
দরজার খিল।
- তাঁর মাঁয়ের মাংস তোমার নাম।
- যেতে দেব না তোমাকে যদি না আমার নাম বলতে পারো তুমি।বলে ওঠে
দরজার রক্ষক।
- তুমি শু-এর শক্তি, যা রক্ষা করে ওসিরিসকে
- হেঁটে যেতে পারবে না আমার ওপর দিয়ে, যদি না আমার নাম বলতে
পারো তুমি।ভূমি
বলে।
- আমি পবিত্র। আমি নির্বাক।
- যে দু’পায়ে আমার ওপর দিয়ে যাবে তুমি নাম বলো তাদের।
- আমার ডান পায়ের নাম আমসুর অতীত, আর আমার বাঁ পা নেপথিসের
শোক।
- যাও আমার ওপর দিয়ে। আমাকে তুমি চেনো।
অনুপম- দারুণ! কিছু বিশেষ অনুষঙ্গের
উপরে দখল লাগবে পাঠকের এই কবিতায় প্রবেশ করতে। কিন্তু, সত্যিই দারুণ।
অমিতাভ- যে কোনো মন্ত্রে
সাধারণ নিয়মেই বারবার ফিরে আসে কিছু ধ্বনি, কিছু অনুষঙ্গ আর সবার ওপরে কিছু শব্দ-
যারা মিলে একটা ঘোর একটা সম্মোহন তৈরি করে... অনুপম আমি জানি আমি “ নাইন্থ
সিম্ফনি” নামের একটা সুন্দর কবিতার বই নিয়ে কথা বলছি। এখানে ওসিরিসের নেতৃত্বে
মৃতের হৃৎপিণ্ডের পরিমাপ নিয়ে বকবক করার মানে হয়না। তবু তুমি কি আমাকে সময় দেবে
একটু, হে অনুপম, হে চন্দ্র দেবতা থথ্?
অনুপম- উঁহু। আমি তো কর্ণ। বসুষেণ। কথা
বলা এবং শোনায় আমার নিদারুণ আগ্রহ। অর্জুন আমাকে মারবে, কারণ আমি বক্তা।
অমিতাভ- ভাল বলেছ। একটা
নকশায় আছে মৃত আত্মা তানহাই কে পথ দেখিয়ে বিচারসভায় নিয়ে আসছে হোরাস যেখানে তানহাইয়ের
হৃদয়ের ওজন নেওয়া হবে। একটা তুলাদণ্ডে তানহাইয়ের হৃদয় রাখা। সত্য ও ভারসাম্যের
দেবী মাঠ সামনে আছেন।শেয়ালের মাথাওয়ালা দেবতা আনুবিস, দানব আম্মাট সবাই
হাজির।চন্দ্রের দেবতা থথ্ পরীক্ষার ফল লিখে রাখছেন। এগারোজন দেবতা উঁচু আসনে বসে
আছেন সাক্ষী হিসেবে। সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে তানহাই তার পূর্বজীবনের কথা বলছে-
“ অভিবাদন
তোমাকে, যার পদক্ষেপ দীর্ঘ এবং আমু থেকে সৃজিত যে/আমি কোনো অন্যায় করিনি/অভিবাদন
তমাকে/অগ্নিশিখায় আশ্রিত এবং খেরবা থেকে সৃজিত যে/বলপ্রয়োগে কিছু লুণ্ঠন করিনি”।
অভিবাদন হে
ফেনতিউ,খেমেন্নু থেকে সৃজিত যে/আমি চুরি করিনি
অভিবাদন হে
ছায়ার ভক্ষক, কোয়েবনেট থেকে সৃজিত যে/ আমি হত্যা করিনি, কারো ক্ষতি করিনি/ আমি
উচ্ছ্বিষ্ট করিনি কোনো দান, কোন নৈবেদ্য।/ আমি হরণ করিনি দেবতাদের, মিথ্যা বলিনি/
কারো খাবার কেড়ে নেইনি, ব্যাথা দিইনি কাউকে, / যৌন অপরাধ করিনি এবং কারো অশ্রপাতের
কারণ হইনি,/ প্রতারনা করিনি কাউকে/ কর্ষণের অপমান করিনি আর হত্যা করিনি কোনো
গাছকে/ শিশুদের খাবার বিষাক্ত করিনি এবং চিন্তাহীন সিদ্ধান্ত নিইনি কখনও/ রাজা বা
ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দাঁড়াইনি/অসম্মান করিনি মৃতদেহ/উদ্ধত হইনি এবং যা নই তেমনভাবে
বিম্বিত করিনি নিজেকে/ আমি সংযুক্ত থেকেছি প্রবাহের সাথে।“
“The book of The
dead” কে এখানেই হাত তুলে বিদায় জানানো যাক। অশোক ঘোড়ই এর কবিতার
ভাষা মসৃণ। কোথাও কোনো ধাক্কা সহসা নড়বড়ে করে দেয়না পাঠকের মনোযোগ কে। (কবিতা কোন মার্শাল আর্টের ক্লাস নয় যে তুমি
বেমক্কা ধাক্কা দেবে পিছন থেকে বা দুরন্ত একটা আপারকাটে আমাকে পেড়ে ফেলবে।এরকম কবিতা চোখে পড়ে এবং পড়ার কোনো আগ্রহ হয়না।) মৃত্যুর মতো ঠাণ্ডা স্রোত ওর কবিতায়-
যেখানে শববাহক, পোড়া শরীরের গন্ধ, রাত্রে ঘুরে বেড়ানো খরগোশ, মোহর দেখার পর খিদের যন্ত্রণা
কমে যাওয়া শিশু, হাতের তালুতে পেরেকে স্মৃতি ফুটে ওঠা(খ্রীষ্ট, অবশ্যই)ফুলবিক্রেতা-
যেন এক চলমান স্বপ্নদৃশ্যের মতো ঘুরে বেড়ায়। ভেজা নীল বার্নট সায়না
আর কালো রঙে আঁকা এক সারি ছবির মতো অশোকের কবিতা-
শববাহকদের লাইন সোজা রাখা
শববাহকদের লাইন সোজা রাখাই তার কাজ
এবং ফুলের তোড়া
আবর্জনাস্তুপে ছুঁড়ে দেওয়া। শিশুদের শব দেখলে সে
প্রথামাফিক
দুঃখ প্রকাশ করে। যেদিন ফুল দিয়ে সাজিয়ে
তারই শবদেহ বয়ে
নিয়ে এল অনেকে, সেদিনও সে লাইন সোজা করতে লাগল এবং
ফুলগুলোকে ছুঁড়ে দিল আস্তাকুঁড়ে।যখন চুল্লিতে সে ফুটতে শুরু
করল,তখন সে একঝাঁক শিশুকে ছুটে আসতে দেখল তার দিকে।
তখনও সে প্রথামাফিক দুঃখ প্রকাশ
করল। শিশুরা তার কানের কাছে
চিৎকার করে বলল, “ আমরা মরিনি”
যেন স্থির কোন ক্যামেরায় চোখ নিয়ে
কবিতাগুলো দেখেছে অশোক।এবার ঠিক পরের কবিতাটি
পড়বো- যেখানে ক্যামেরাটি একইজায়গায় একইভাবে স্থির
হয়ে আছে।
শববাহী গাড়িদের যাতায়াতের সময়
রাত্রে শববাহী গাড়িদের যাতায়াতের
সময় ট্রাফিকের দায়িত্ব সে একাই
সামলে নেয়। সমস্ত ট্রাফিক সিগন্যালে সে বাজিয়ে
দেয় মাহলারের
নাইন্থ সিম্ফনি। অন্যান্য গাড়িগুলো রাস্তার
বামদিক চেপে শব্দহীন স্থির
হয়ে যায়। এতদিনে সমস্ত চুল্লিই
জলের তলায় চলে গেছে।শববাহী
গাড়িগুলো রাস্তাতেই লাইন দিয়ে ঘুরে
বেড়াতে থাকে। সে জানে,
এমন নিঃশব্দ রাত্রির সফর শবদেহ কিংবা
নাইন্থ সিম্ফনি কেউই
ভুলতে পারবে না
হাত থেকে যেন
নামানো যায়না বইটি। কিন্তু, নামিয়ে রাখি?
আজ এখানেই বরং কথা শেষ করি আমরা? আবার বসা
যাবে। (ক্রমশঃ)
এই কথোপকথন শেষ হলে মন খারাপ করবে... আপাতত অপেক্ষা।
ReplyDeleteকবিতার প্রবহমানতায় যে অন্ধকার ও জীবনের সম্মোহন তা উপলব্ধি করতে পারছি। পাঠের ব্যাপ্তি ও নিভৃতি কোন প্রজ্ঞার অতলে ডুবিয়ে দিলে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যখন জেগে উঠলাম তখন বুঝতে পারলাম সেলিম মন্ডল, দেবদাস আচার্য আর অশোক ঘোড়ই এর কাছাকাছিই আছি।
ReplyDelete