।। বাক্ ১২৫।। আমার বাবা।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়।।





আমার বাবা



 ১০

এই ধারাবাহিক লিখতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঘটনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা  মুশকিল হয়ে পড়ছেতবু যথাসম্ভব আমি তা চেষ্টা করছি কিন্তু অনেক অনেক ক্ষেত্রে সময়রেখাকে ঠিক ঠাক মান্যতা দেওয়া আমার পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে  না এর দুটি কারণআমি যে সময়ের কথাগুলি লিখছি তা আমার চোখের সামনে ঘটেনি, আমার পৃথিবীতে আসার আগে যা বাবা ঠাকুমা বা পরিবারের অন্যান্য গুরুজনদের কাছে শোনা এবং বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় লিপিবদ্ধ তথ্যের আশ্রয় থেকে খুঁজে নেওয়া তা যে সুবিন্যস্ত একথাও বলা যাবে নাদ্বিতীয়ত স্মৃতিচারণা এমনই এক বিষয় তাকে সময়ের শাসন দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। যখন যাদের কথা মনে পড়ে বা যে বিষয়গুলি হাতের কাছে এসে যায় তাকে কোনভাবেই এড়ানো যায় না।   

ত্রিবেণীপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ও প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায়



আমাদের জমিজায়গা সেরকম আহামরি কিছু ছিল না কোনকালেই কিন্তু শিক্ষার বাতাবরণ ছিল পুরুষানুক্রমে প্রপিতামহ পীতাম্বর আচার্য (আচার্য আমাদের রাজপদবী, পঞ্চকোটরাজ প্রদত্ত) ছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শকবংশানুক্রমে শিক্ষকতার ধারা পরিবারে বিদ্যমান ছিল, অধিকাংশই শিক্ষকতার সাথে যুক্তসুধীরজেঠু  বেনারস  থেকে সংস্কৃতে প্রাজ্ঞ এবং কাব্যতীর্থ পাশ করেছিলেন তাঁকে খুব ছোটবেলায় সামান্যই দেখেছি।ফলে অকালপ্রয়াত এই মানুষটির বিশেষ কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। কিন্তু তাঁর বাগ্মীতা, পাণ্ডিত্য এবং সংস্কৃত সাহিত্যে গভীর বুৎপত্তির কথা শুনেছি। স্থানীয় মণিহারা হাই স্কুলে তাঁকে শিক্ষকতা করার আবেদন জানালেও তিনি তা গ্রহণ করেন নি।বলেছিলেন বাঁধা ধরা রুটিনের মধ্যে তিনি আটকে থাকতে রাজি নন। সাহিত্যের প্রতি গভীর মগ্ন থাকতেই ভালোবাসতেন।এই নিয়ে গভীর আলোচনা তর্কও করতেন।প্রচুর রাগী এবং তীব্র জেদী মানুষ ছিলেন ফলে জীবনে স্থির হয়ে তেমন কিছু  করতে  পারেন নি।অবশ্য এসব তুচ্ছ জাগতিক বস্তুসমূহের হিসেব নিকেশ তিনি করতেন বলেও আমার মনে হয় না। আমার জেঠু ত্রিবেণীপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এবং শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় যাঁদের কথা আগেও বলেছি দুজনেই অত্যন্ত মেধাবী এবং কৃতি ছাত্র ছিলেন। রামানন্দ কলেজ থেকে  প্রথম শ্রেণিতে আই এস সি পাশ করেও আর্থিক সংকটের  কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়নি। তবু তাঁরা দুজনেই কেন্দ্রীয় সরকারের  দায়িত্বশীল পদে চাকরি করেছেন ( ত্রিবেণীপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথমে মিলিটারিতে ওয়ারেন্ট অফিসার এবং পরে সিভিলে এসে ডাক ও তার বিভাগে যোগদান করেছিলেন, শিবপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়  ইষ্টার্ন রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত  Divisional Engineer ( D.EN)




 রাখহরি গঙ্গোপাধ্যায় ও খুদুবালা গঙ্গোপাধ্যায়


জমিজায়গা এসবের উপর গ্রামীণ মানুষের মোহ থাকে অন্তত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় তৃতীয় দশকে তা তীব্রতর ছিল আমার দাদুর মধ্যে তা ছিল না তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যায়  আমার দাদু জমিদারী খুব ভালো বুঝতেন না বরং এই সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতাকে অপছন্দই করতেন তার কারণ হচ্ছে তিনি  জমিদারী অত্যাচারের ভয়াবহতা দেখেছিলেন  উল্টোদিকে আমার ঠাকুমা ছিলেন এক জোতদারের একমাত্র কন্যা রঘুনাথপুর থানার ডুমুরকোলা গ্রামে ভূপতি মিশ্রের জমিদার হিসেবে খ্যাতি ছিল বলবার মতোতাঁর পূর্বপুরুষদের বিক্রমএবং প্রতাপ যেমন ছিল পাশাপাশি আকণ্ঠ ভোগবাসনাও ছিল ভূপতি মিশ্র এঁদের চেয়ে অন্য ধারার মানুষ হলেও প্রতাপ তারও কম ছিল না আক্ষরিক অর্থেই বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত তাঁর নামেকিন্তু জীবন খুব সুখকর হয় নি একমাত্র কন্যার জন্মের অব্যবহিত পরই( দু মাসের মাথায়) স্ত্রী বিয়োগ হয় তাঁরএই মৃত্যুই তাঁর জীবনকে বদলে দেয় মানুষটিকে মনেপ্রাণে অনেকটাই কোমল করে দেয় দু মাসের এই মেয়েটিই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান তপস্যা তাকে বাঁচিয়ে রাখার  জন্য যা যা করার তিনি করেছেন একমাত্র আদরের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও সংস্কারবশত নাম রাখেন খুদুবালা  অনেকে তাঁকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন–  ব্যাটাছেলে না থাকলে এত এত সম্পত্তি কে দেখবে তিনি সেসব কথায় কান দেন নি এবং আর বিয়েও করেন নি দাদুর সাথে খুব অল্পবয়সেই ঠাকুমার বিয়ে হয়ে যায়।যে অঙ্ক ভেবে ভূপতি মিশ্র এই কাজটি করেছিলেন তা যে ভুল ছিল তা অচিরেই প্রমানিত হয়। দাদু ঘরজামাই হতে রাজী হন নি। এমনকী জমিদারীর প্রতি কোন মোহ নেই সেকথা বুঝিয়ে দিতে তিনি শিক্ষকতাকেই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন।
এইভাবেই শিক্ষকতার ধারাটি পারবারিক ভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। বাবাও শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘ ৩৫ বছর।দাদু যখন সাঁতুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বছর দশেক চাকরি আছে সেরকম সময়েই বাবা আমবাড়ি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তখন বাবা এবং দাদু দুজনে একসাথেই সাঁতুড়িতে থাকতেন। সেখানে একটি ছোট বাড়িও ছিল।ছোটবেলা থেকেই বাবার শরীর স্বাস্থ্য খুব ভালো ছিল না। প্রায়ই ভুগতেন তার উপর ছিল ফিটের ব্যামো। ফলে দাদুর একটু বেশি মাত্রায় স্নেহ ছিল বাবার প্রতি।  
আমার জেঠুমণি ছিলেন মিলিটারী অফিসার। অত্যন্ত মজার গল্প বলতে পারতেন এবং মাতিয়ে রাখতেন আসর। অনেক সিরিয়াস ঘটনাকে মজা করে বলতেন বলে আমাদের খুব ভালো লাগতসত্যের চেয়ে মজাদার বিষয়গুলিই আমাদের পছন্দ হত বেশি। অনেক স্বপ্নের কথা বলতেনযুদ্ধের কথা বলতেন। নিজের জীবনের যুদ্ধের কথাওনিঃসন্তান এই মানুষটি জীবনে অনেক ব্যথা ও বেদনা  অনুভব করেছেন।এক সময় তীব্র অভিমানে নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। 
  ক্লাস ফোরে তখন বৃত্তি পরীক্ষা হত আমার মা গীতা মিশ্র  বৃত্তি পেয়েও ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে পারেননি কারণ হাই স্কুল ছিল দূরে মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে তখন পরিবারে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ফলে অতদূর, মেয়েদের একা একা স্কুলে পাঠানোর কথা  ভাবতেও পারত নাআমার মাতামহকে আমি যতদূর দেখেছি খুব রক্ষণশীল মনে হত না বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবনাচিন্তা ছিল তখনকার দিনে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেট পাশ করেছিলেনঘরের তীব্র বারণ সত্ত্বেও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মিলিটারিতে বেশ কিছুদিন চাকরি করেছিলেন ফলে জীবনযাপনে তীব্র শৃঙ্খলা ছিলপরে বড় হয়ে অনেকবিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে এবং বিতর্কও ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে  সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়েই ছিল তাঁর ভাবনা কিন্তু এই একটি বিষয়ে কেন যে তাঁর মধ্যে এত রক্ষণশীলতা ছিল তা আজও বোধগম্য হয় না প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ক্লাস ফোরে শেষ হয়ে গেলেও মায়ের জ্ঞানের চর্চা থেমে থাকেনি বইপড়া এবং জটিল অঙ্ক করার অভ্যাস ছিলই জটিল জটিল অঙ্ক মুখে মুখে করে দিত পারেন অনায়াসে
সিরজাম স্টেশনে পটল মিশ্রের চা চপের দোকানটি ছিল তখন সারা এলাকার প্রাণকেন্দ্রসমস্ত রকম খবরের আদান প্রদানও হত এখান থেকে তিনি দাদুকে একদিন বললেনকমল, তুই তো মেয়ের জন্য পাত্র দেখছিসআমার সন্ধানে একটি ভালো ছেলে আছে দেখতে পারিস দাদু উৎসাহিত হয়ে বললেনকোথায়?
বেশিদূরে নয়, এই সামনেই শিয়ালডাঙা।'
দাদুকে একটু ইতস্তত করতে দেখে তিনি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি টানলেনজল খাবি ছাইন্যে আর কুটুম করবি জাইন্যে চেনাজানার মধ্যে আত্মীয়তাই তো ভালো
তবু দাদুর দ্বিধা আর যায় না বলেছেলে করে কী?
'মাস্টার ! রাখু গাঙ্গুলির মেজ ছেলে।'
মাস্টার শুনে দাদু একটু ঘাবড়েই যান- সেই তো পাঠশালার পন্ডিত ছেলে বাগালী কাজ
দাদুর চিন্তান্বিত হওয়ার কারণ ছিল তখন শিক্ষকদের সম্মান প্রচুর থাকলেও আর্থিক নিরাপত্তার দিকটি অবহেলিতই ছিলফলে একমাত্র মেয়েকে এরকম পাত্রে পাত্রস্থ করার ক্ষেত্রে এক কথায় রাজী হওয়া তাঁর পক্ষে  সম্ভব ছিল নামেয়ে তাঁর হলেও তখন পারিবারিক মতামতই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ফলে তিনি বললেনঠিক আছে বাড়িতে আলোচনা করে দেখি
জমি জমার সাধারণ অবস্থা, ঘরে আইবুড়ো বোন এরকম আরও অনেকগুলি কারণে সম্বন্ধ প্রায় ভেস্তে যাওয়ারই উপক্রম কিন্তু তবু বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হল  ১৩৭৩  বঙ্গাব্দের ৯ বৈশাখ, ইংরেজি ২৩ এপ্রিল ১৯৬৬
যে মানুষটির জন্য তা সম্ভব হয়েছিল তিনি হলেন  গোষ্ঠবিহারী মিশ্র মায়ের বড় জ্যাঠামশায় তিনি বললেন জমি হল যম, ওসব আজ আছে কাল নেই কিন্তু যেখানে বিদ্যার চর্চা আছে, সংস্কৃতির চর্চা আছে তারা একদিন না একদিন ঠিক ঘুরে দাঁড়াবেই
                                                                                             
                                                                                              (চলবে)


1 comment:

  1. ভারি সুন্দর স্মৃতির সরণি। আন্তরিকতার স্পর্শ প্রতিটি পর্বে। অতীত থেকে বর্তমান All time is eternally present.

    ReplyDelete