।। বাক্ ১২৫ ।। আঁধার লিপি : রঙ্গন রায় ।।











দ্বিতীয় পর্ব




          প্রত্যেকের একটা গল্প থাকে। আর সেই সাথে থাকে একটা পড়ে যাওয়ার গল্প। আমাদের অধিকাংশেরই গল্পটা সেই পড়ে যাওয়ার। কিন্তু হাত ধরে টেনে তোলার লোকের বড় অভাব। রাস্তায় পড়ে পাওয়া ১০টাকাটিও পকেটে পুরে ভিখিরীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নির্বিকার চলে যেতে পারি , মনে মনে ভাবতেই পারি , ভিক্ষা কেন? কাজ করে খেতে পারেনা? কিন্তু কাজটা কে দেবে সেটা ভাবিনা , ভাবার চেষ্টাও করিনা , ভাবা প্র্যাকটিস তো অনেক দূর। এইভাবে ১০টাকার পর ১০টাকা কুড়িয়ে বাড়িয়ে ভিখিরীর পড়ে যাওয়ার যে চিরন্তন গল্প তাতে সনির্বন্ধ ইন্ধন  জুগিয়ে চলি। আসলে কে পড়ে যাচ্ছে গল্পে তা আর নজর দেওয়ার সময় হয়না। সময় যে দৌড়চ্ছে , আমাকে তার চেয়েও জোরে দৌড়তে হবে , নয়তো বাস মিস্ করবো।
        গল্প মানেই নায়ক থাকবে , এবং আমাদের সকলেরই কমবেশি নায়ক হওয়ার ইচ্ছা ষোলোআনা। আর নায়ক থাকলে তো তার একটা নায়িকা  থাকা বাধ্যতামূলক , নাহলে গল্প জমেনা। ডিপ ফ্রিজেও গল্পকে রাখা যায়না। কেননা ফ্রিজ কেনার সামর্থ্যই নায়কের নেই। আসলে পড়ে যাওয়া গল্পের নায়কেরা বাস্তবে যাত্রার "রাস্তার ছেলে রাজকুমার" হতে পারেনা। 
        
      বাস থেকে নেমে আমি আর কোনো দিকে তাকালাম না। হয়তো আমার দখল করা বসার জায়াগায় দাঁড়িয়ে থাকা কেউ গরমকালে গ্রামের টলমলে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মত অধিকার করেছে। আদিবাসী রমনীর দিকেও এখন আমার চোখ যাচ্ছেনা। উনি কি এই বাসে আর উঠবেন? যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানে আর যেতে পারবেন? না , কিছুই দেখিনি আমি। এমনকি আমার পাশ দিয়েই যে জ্যাঠতুতো দাদার বন্ধু পরিমল দা বেরিয়ে যাচ্ছিলো এবং নিজেই ডেকে আমায় থামালো , আমি তাকেও দেখিনি। আমার চোখ থেকে ঐ এক্সপ্রেশন এখনো ছুটে যায়নি।
      পরিমল দা নামটা আমার পছন্দ নয়। কেমন মুদি দোকানি দোকানি লাগে। কিন্তু তাতে এই পৃথিবীর কিছুই এসে যায়না , পরিমল দারও কিছুই এসে যায়না।
"কিরে কোথায় চললি? কলেজ বন্ধ?"
ঘোরটা কেটে গেলে মুশকিল বলে ছোট্ট করে নিরপেক্ষ উত্তর দিলাম ,
"হুঁ।"
"মন খারাপ নাকি! ধুর , তোদের বয়সী এই ছেলেমেয়েদের দেখি অলটাইম ফ্রাস্টু খেয়ে ঘুরে বেরায়। আরে বাবা , এঞ্জয় কর এই বয়সটাকে। ফ্রাস্টু খাওয়া সিগারেট খাওয়ার চেয়েও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।"
     আমি কোনো উত্তর দিলামনা। বাস্তবিকই দাদার বন্ধুরা দাদার মতই জ্ঞান দেওয়া পাব্লিক হয়। যেখানে সেখানে যাকে তাকে জ্ঞান দিয়ে বেড়ানোটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। আরে এতই যখন জ্ঞান তখন এস এস সি টা টপকাতে পারলেনা কেন? কিন্তু এসব কথা বলা যায়না। খালি মনের মধ্যেই ঘুরপাক খায়।
"আরে বিন্দাস থাক। একটা ভালো মুভি দেখ আর সন্ধ্যায় বাবুঘাটে গিয়ে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দে , দেখবি ফ্রাস্টু বাস্টু খেয়ে উড়ে গেছে। হাহাহা!"
      আমি চুপ করে শুনে গেলাম। আর প্রত্যুত্তরে একেবারেই নীরব থাকাটা সমীচীন নয়। দাদাকে গিয়ে লাগিয়ে দেবে নাহলে। কাজেই একটা হাসি আমায় দিতে হল যা আপেক্ষিক ভাবে ভিজে বেড়ালের মুখের মত। অবিশ্যি ভিজে বেড়ালেরা হাসতে পারে কিনা সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কিছু বলে যায়নি।
"তাহলে চল! টাটা!"
     বলে পরিমল দা ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা পা ফেলে ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল। এই বিদায় সম্ভাষণটা আমার হেব্বি মটকা গরম করে দেয়। যেই জ্ঞান দেওয়া কমপ্লিট , ঝুলিতে আর অবশিষ্ট নেই অমনি কেটে পড়া , এবং "চল টাটা!" আরে! ও আমাকে চলতে বলার কে? আর আমি চলবোই বা কেন? আমিতো এখানে চুপ করে দাঁড়িয়েও থাকতে পারি! আর এই যে বলে গেল ফ্রাস্টু খাওয়া , শালা তোমার ফ্রাস্টু নেই? ৩০ বছর বয়স অবধী বেকার হয়ে বসে আছো! তাছাড়া আমার কোনো ফ্রাস্ট্রেশন নেই। সকালের একটা অস্বস্তিকর গন্ধ দিয়ে দিন শুরু হয়েছে , আনআইডেন্টিফাইড গন্ধ। তারপর সেই এক্সপ্রেশন --- উফ্! আর ভাবা যাচ্ছেনা।
যেকোনো উপন্যাস লিখতে গেলেই তাতে একটা ফ্ল্যাশব্যাক আনা ভীষণ জরুরী , এতে করে করে পাঠক উপন্যাসে পঠিত চরিত্র সমন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারনা পায়। অতীত এবং বর্তমান জানলে চরিত্রের ভবিষ্যৎও খানিক আন্দাজ কিংবা কল্পনা করে নিতে পাঠক ভালোবাসে। মানে আমি আমার ব্যক্তিগত পাঠ অভ্যাসের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি কথা গুলো।
শীতের রোদে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সিমেন্টের বসার বেদীটায় গিয়ে বসলাম। এখন কোনো গন্তব্য নেই। অজস্র ঘটনা মাথায় ভীড় করে আসছে। পরিমল দা মাঝখানে একটু ঘেঁটে দিলেও তারা আবার ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টির মত ফিরে আসছে। সেই বৃষ্টি দিনের কথা কখনো ভোলা যায়? সে বছর দুই আগের কথা। তখনও উচ্চমাধ্যমিক দিইনি। সদ্য টুয়েল্ভে উঠেছি। একদিন বাড়িতে সকাল সকাল সম্রাটদা এসে হাজির। এত সকালে একটা লোক বাড়িতে এলে মোটেই ভালো লাগেনা। কেননা সদ্য ঘুম থেকে উঠে কিছু সময় একান্তই নিজের সাথে কাটাতে আমি ভালোবাসি। চা খাবো , জানালার ধারে চেয়ারে বসে পেয়ারার ডালে চড়াই পাখি দেখবো , দেখতে দেখতে ঘুম ঘুম ভাবটা হাল্কা আবার ফিরে আসবে , এইতো জীবনের একমাত্র উপভোগ। নিজেকে ভালোবাসা। কিন্তু সেই সাত সকালেই শিলিগুড়ি থেকে সম্রাটদা সোজা বাড়িতে চলে এসেছিল , বলেছিল ,
"দেবাঞ্জন , ব্যাগ গুছো , চ নক্সালবাড়ী।"
"মানে? এখন নক্সালবাড়ী! কি জন্য?"
"তুই বলেছিলি নক্সালদের গোপণ মিটিংয়ে যাবি। এই ২০১৫ সালের নক্সাল দেখবি , আজ চ আমার সাথে। আজ থেকে তুইও কমরেড হবি , আমাদের দলের।"
সাথে সাথে রক্তে গর্জে উঠলো সত্তর দশকীয় চিন্তাস্রোত। যেন আমিই সেই সময়কার একজন শহীদ নক্সাল যে এই সময়ে জাতিস্মর হয়ে জন্মেছি। সেই উত্তাল সময় আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ফুটে উঠছে , 'চীনের চেয়ার ম্যান ---' কিন্তু এসমস্ত কিছুই বই পড়ে - সিনেমা দেখে - ম্যাগাজিনের পাতায় ফোটোগ্রাফি দেখে জানা। অথচ ভেতরে কিছু একটা যেন হচ্ছে , এই গণতন্ত্রের নামে রাজতন্ত্র চলা ভারতবর্ষে প্রকৃত গণতন্ত্র নক্সালরাই ফিরিয়ে আনতে পারবে। সত্যি সত্যিই হয়তো বন্দুকের নলই ---
"কি ভাবছিস এত? আরে তোদের মত তরতাজা ছেলেরাই তো এই দেশের কান্ডারী। আমাদের দলের মেরুদণ্ড বেঁকতে বেঁকতেও ভাঙেনি এখনো , , আজই আমাদের দলে নাম লেখাবি। বেনুদাকে তোর কথা বলেছিলাম , উনিই আজ নিয়ে যেতে বলেছেন তোকে , কিন্তু যেখানে নিয়ে যাবো সে জায়গার কথা কিন্তু তুই ভুলেও কাউকে বলতে পারবিনা!"
এই সাত সকালে এসব শুনে ডিসিশন নিতে পারছিনা। আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। ঐসব মিটিংয়ে গিয়ে যদি কোনো বিপদে পড়ে যাই? দন্ডকারন্যে মাওবাদীদের দুঃসহ অবস্থার কথা আমি জানি। ঝাড়গ্রাম - ছত্তিশগড় সব জায়গার নক্সালরা কি ভীষণ বাজে পরিস্থিতিতে আছে সব জানি , পড়েছি বইয়ে - কাগজে। এসব চিন্তায় আমার মুখে কোনো এক্সপ্রেশন ফুটে উঠেছিল হয়তো , সেটাই স্বাভাবিক , তা দেখে সম্রাট দা বললো ,
"কিরে ভয় পাচ্ছিস নাকি! বিপ্লবীরা কখনো ভয় পায়? আরে এতো প্রেমের মত! এখানে নারী হচ্ছে দেশ , প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। নক্সালরা কখনো ভয় পায়না , শিরায় শিরায় জাগিয়ে তোল সেই সত্তর দশকীয় উদ্দাম। কিচ্ছু হবেনা। চল আমার সাথে।"
"তুমি বসো সম্রাটদা , চা খাও। আমি বাবার সাথে কথা বলে আসছি।"
"আরে গাঁধা!  বাবাকে বললে বাবা কখনো যেতে দেবে? অন্য কোথাও যাওয়ার কথা বলবি। বলবি শিলিগুড়িতে কবি সম্মেলন আছে , আজ তো রবিবার , এরকম সম্মেলন টম্মেলন লেগেই থাকে ফি রোব্বার , তুই কবিতাও লিখিস ছেড়ে দেবে। কিন্তু খবরদার নক্সালের কথা বলিসনা কিন্তু , তাহলে হবেনা। বুঝলি?"
"আচ্ছা।"
আমি আর কিছুই বলতে পারলামনা। প্রকৃত প্রস্তাবে আমার মন দোলাচলে , দুই নৌকায় আছে এই মূহুর্তে। জানি বাবাকে সত্যি কথা বললে বাবা হারগিস যেতে দেবেনা , আর আমি মিথ্যা কথা বলতে পারিনা। আমার যাওয়ার ইচ্ছাও ফিফটি পার্সেন্ট না যাওয়ার ইচ্ছাও। ঝোঁকে ঝোঁকে একবার ঢুকে পড়লে আর বেড়িয়ে আসা মুশকিল। কিন্তু তবুও ভেতরে একটা বিপ্লবী সত্ত্বা চাপ দিচ্ছে , যেতে বলছে।
সম্রাটদাকে ঘরে বসিয়ে আমি ভেতরে গেলাম। বাবা এখন খবরের কাগজ পড়ছেন। একটু আগেই বাজার সেরে ফিরে এসেছেন। এখন আয়েশ করে চায়ের সাথে খবরের কাগজ। আকাশ মেঘলা মেঘলা , তাই গরমটা গুমোট। বাবা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে খবরের কাগজ পড়ছে বাবু হয়ে। এই লুঙ্গির কোলটা দেখলেই আমি ছোটোবেলায় ফিরে যাই , যখন বাবা আমাকে কোলে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো , আমার সারা মুখে বাবা বাবা গন্ধ। এখন ঐ দুর্দান্ত কোলটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। এতোটা বড় বোধহয় হওয়া উচিৎ ছিলনা। বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। সকাল সকাল ঐসব কথা আমি বলতে পারবোনা। নক্সাল আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে ভালো নয়। বাবা আমাকে কয়েকদিন আগেই বলেছিল , " নক্সাল নিয়ে এতো পড়াশোনা করছো ঠিক আছে , কিন্তু বেশি মাথা ঘামিও না। মনে রেখো তোমার বাবা দরিদ্র , কিছুই নেই আমাদের। তোমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে , চাকরী পেতে হবে , এবং চাকরী তোমাকে রুলিং পার্টিই দিতে পারে , অ্যান্টিপার্টি নয়। তাই ওসবে কোনোদিন ভুলেও জড়াবেনা। আমাদের জন্য রাজনীতি নয়। আমাদের কোনো রং নেই। গরীবের ছেড়া পালে যেদিকে হাওয়া লাগে সেদিকেই নৌকা ছোটাতে হয় , নাহলেই ভরাডুবি। তুমি শিক্ষিত , ভালো পড়াশোনায় , সবটাই বোঝো , একবার রং লেগে গেলে চাকরী পাওয়ার স্বপ্ন শেষ। আর তোমাকে সরকারি চাকরীই পেতে হবে। আমরা আর কষ্ট করতে পারছিনা।"
আমার খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন। সত্যি কথা। এই নক্সাল নক্সাল করেই এতো ভালো স্টুডেন্ট সম্রাটদা একটা সরকারি চাকরী পায়নি। এখন প্রাইভেট কোম্পানির সেলসম্যান , কুত্তার মত খাটিয়ে মারে। বাবার মুখের সেই কষ্টের ছাপ আমার মনে পড়ে গেছে ঐ আদিবাসী রমনীর এক্সপ্রেশনে , তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে , পরপর সমস্ত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্রেন কত পাওয়ারফুল , একটা ঘটনা - একটা ছবি কেমন একটা উপন্যাসের জন্ম দিতে পারে! সেই দারিদ্র্য , সেই অভাব , জীবন যেখানে পান্তাভাত ছাড়া আর কিছু নয় সেখানে সত্যি সত্যি সব মিথ্যা হয়ে যায়।






একটি বেঁধে রাখা গরু। কখন দড়ি খোলা হবে এই চিন্তায় - অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তারপর খুলে দেওয়া হলো , একদম মুক্ত করে দেওয়া হলো। বিরাট পৃথিবীর বিশালতা কে মুহুর্তের মধ্যে উপভোগ করতে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য সে গরুর মাথা কাজ করেনা। পাগলের মত দৌড়য়। সেকি দৌড়! যেন বাঁধা থাকা সমস্ত সময়ের দৌড় টাকে সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে , এতটাই প্রবল সে। দড়ির দৈর্ঘ্যের বাইরে যে জগৎ , তার যে অসীম দৈর্ঘ্য , তার যতটুকু সম্ভব চেটে পুটে নেয় সে।
মানুষেরও এরকম হয়। অনেকদিন শহরে বন্দী থাকার পর যখন খোলা মাঠ দেখা যায় , পাগুলো সুড়সুড় করে , খুব সুড়সুড় করে। মনে হয় উন্মাদের মত চক্কর দেওয়া শুরু করি। এ মাঠের সমস্ত কোনায় আমার বন্দী পদচিহ্নকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আত্মসংযম গরু পারেনা। মানুষকে পেরে নিতে হয়। জিনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে এ সত্ত্বা। অনন্ত দৌড় সেতো শিশুর খেলা। আমরা কি মাঝেসাঝে শিশু হতে পারিনা? এইযে এই বিশাল শহর , আমি কতদিন দৌড়াইনি , আজ কি দৌড়নো যাবেনা?  আজ তো কলেজেও গেলামনা , ঐ এক্সপ্রেশনটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা আমার এরকম হচ্ছে কেন? না এখনই দৌড় শুরু করি। শহরের মাঝখান দিয়ে দৌড়। হয়তো সমস্ত লোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে , থাকুক , তবেই ওই ভাবনাটা কেটে যাবে।
"দেবুদা না?"
মিষ্টি রিনরিনে গলার স্বরে একটু চমকে গেলাম। এই সময় আমাকে ডাকছে কে? তাও আবার নারী কন্ঠ! যদি আমাকেই ডেকে থাকে তাহলে এবার এই এতক্ষণ নারী বর্জিত কাহিনীতে একটু রসের সঞ্চার হবে।
"হ্যাঁ , কে গো?"
"আরে আমি রঞ্জনা। ভুলে গেছো আমায়!"
"না না ভুলবো কেন! আসলে একটা অন্য ভাবনায় ছিলাম তো -"
"তাই ভুলে গেছো! তা কি এত ভাবছো বাস স্ট্যান্ডে বসে এইভাবে রাস্তায় মুখ গুঁজে! "
"ও কিছু না রে , বুঝবিনা।" কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলাম। "তারপর বল কেমন আছিস? এদিকে কোথায় এসেছিস?"
"আরে আমি আর কয়েকজন বান্ধবী মিলেনা স্কুল পালিয়েছি। ওরা বয়ফ্রেন্ড দের সাথে ঘুরতে গেছে। আমি আর ঐ যে মিষ্টু দাঁড়িয়ে আছে , দুজনে এমনি ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে তোমাকে দেখলাম।"
এতক্ষণে আর একটি নীল সাদা চুড়িদার পড়া মেয়েকে দেখলাম , দূরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু লজ্জা লাগলো , আমি কি বাজে ভাবে বসে আছি আর একটা মেয়ে আমাকে এতক্ষণ ধরে দেখে নিল। মাথার টুপিটা একটু ঠিক করে নিলাম এবার।
রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ," কোন ক্লাস হলো এবার তোর?"
"নাইন।"
"বাপরে!  তোরা নাইনেই লাইন মারা শুরু করে দিয়েছিস!"
পরিবেশটা মজাদার করবার জন্য এই বাজে জোকস্ টা আমাকে বলতে হল।
"ধুর , কি যে বলোনা দেবুদা! আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই , ঐ মিষ্টুরও নেই। অন্যদের আছে ওরা গেছে। আমরা তো এমনি ঘুরছি।"
"হমম , ভালো।"
এই ফাঁকে রঞ্জনার পরিচয়টা দিয়ে দেওয়া যাক। ও আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। একদম ছোটো থেকে ওদেরকে চিনি। আজ প্রায় বছর খানেক বাদে দেখলাম। এক বছরেই মেয়ে বালিকা থেকে দুরন্ত কিশোরী হয়ে পড়েছে। দামাল হয়েছে দেখতে। উফ্!  যে দেখবে সে'ই প্রেমে পড়ে যাবে। আমার একটু একটু গর্ব হতে শুরু করলো এদিক ওদিক তাকিয়ে যে একটা এত সুন্দরী কিশোরী এসে নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলছে। লোকে দেখুক! কিন্তু আশেপাশের কর্মব্যস্ত মানুষেরা আমাকে নজর দেওয়ার মত সময় নিয়ে জন্মায়নি। কারোর আগ্রহই নেই আমাদের দিকে। ঐ মিষ্টু মেয়েটিও দেখতে ভালো , তবে রঞ্জনা রঞ্জনাই। এখনো যেহেতু নাইন , যুবতী হয়নি এবং নিয়ম কানুন গুলো শিখে নেয়নি সমাজের , তাই হঠাৎই রঞ্জনা আমার হাতটা ধরে ফেলে বললো ," দেবুদা , চলোনা একটু ঘুরে আসি , কি করছো এখানে বসে বসে ! কলেজেও তো যাওনি মনে হচ্ছে , চলো।"
ওর ফর্সা কিশোরী নরম হাতের ছোঁয়ায় আমার সারা শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। মিষ্টু নামের মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো আমার অবস্থা দেখে। রঞ্জনাকে বললো ,"ওই , তোর দেবুদার হাতটা ছাড় , এক্ষুণি বোধহয় তোর প্রেমে পড়ে যাবে।"
গা জ্বলে গেলো কথাটা শুনে। একটা এইটুকু মেয়ে , আমার থেকে প্রায় ৬ বছরের ছোট , আমাকে নিয়ে মজা করছে! আমি রঞ্জনার দিকে তাকালাম , ও একদৃষ্টে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে , নীল সোয়েটারের তলে ওর সদ্য জেগে ওঠা বুক হাল্কা ওঠানামা করছে। কি সুন্দর চোখ নাক মুখের ছাঁদ। আহা যেন এক্ষুনি ভালোবেসে ফেলবো। কিন্তু এগুলোকে ভালবাসা বলেনা। ভাললাগা ও ভালবাসার অনেক পার্থক্য। আমার সারা সকালের অহেতুক স্ট্রেস কি হাল্কা করে দিচ্ছে রঞ্জনা। ও হয়তো জানেনা , আমি কি রকম অস্বাভাবিক পুরুষ। জানার কোনো দরকারও নেই।
"চল , কোথায় ঘুরবি।" বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। রঞ্জনা এখনো হাতটা ছাড়েনি আমার। কিন্তু মিষ্টুর ঐ কথাটা বলার পর থেকে একটাও শব্দ উচ্চারণ করেনি ও।
"দেবুদা , চলো ফুচকা খাওয়াবে।"
মিষ্টুর এই কথায় হকচকিয়ে গেলাম পুরো। ও , এইজন্যেই এতক্ষন এরা পিছনে পড়ে আছে আমার! কিন্তু ওরা ছোটো , একটা আবদার করেছে , না'ও করতে পারছিনা , বিশেষত রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে। কি আশ্চর্য!  ওর মুখে একটা অদ্ভুত আলো দেখতে পাচ্ছি। ওর চোখে কোনো প্রতারণা নেই। খুব সরল একটা দৃষ্টি।
"হ্যাঁ , নিশ্চয়ই , চল , কোথায় ফুচকার দোকান বল। আমি তো চিনিনা ভালো করে।
"চলো , এসো আমাদের সাথে। "
মিষ্টুর দেখানো রাস্তায় আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। ও আগে আগে যাচ্ছে। রঞ্জনা আমার হাত ধরে , পাশাপাশি। কিরকম সস্তার বাঙলা সিনেমার মত লাগছে ব্যপারটা , কিন্তু এটাই যে ঘটছে। ফুচকার দোকান বাসস্ট্যান্ড থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ। পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য ঘটনার মধ্যে একটি হলো মেয়েদের ফুচকার দোকান মনে রাখা। সব জায়গার ফুচকার দোকানই ওরা অনেক ভালো মনে রাখতে পারে কোনো পুরুষের থেকে। কিন্তু স্কুল ইউনিফর্ম পড়েই ওরা কোন সাহসে স্কুল পালিয়েছে কে জানে। রাস্তা দিয়ে এইসময় যদি কোনো দিদিমণি যায় তাহলে তো গেল! আমার পকেটে এখন মাত্র তিরিশ টাকা আর চারটাকার খুচরো কয়েন আছে। মানে সাকুল্যে চৌত্রিশ টাকা।
ওদের দুজনকে ১০টাকা করে দু জায়গায় ফুচকা দিতে বললাম। রঞ্জনা যেন হঠাৎ জলের তল থেকে হুস করে ওঠার মত কথা বলে উঠলো , "তুমি খাবেনা?"
"নারে , আমার এসব খেলে অ্যাসিডিটি হয় , জানিসই তো। তোরা খা না।"
রঞ্জনার পক্ষে আমার অ্যাসিডিটি হয় কিনা তা জানা আদৌ সম্ভব নয় কারন আজ ওর সাথে আমার ঠিক একবছর পর দেখা , এবং এই দেখাও হতোনা যদিনা ঐ আদিবাসী রমনীর সাথে আজ আমার সাক্ষাৎ না হতো।
আসলে পকেটে যে আর টাকা নেই সেটা বলি কি করে! আমার দারিদ্র্য আমাকে প্রতি পদে পদে লাথি মারে। এর জন্যই আমার প্রথম প্রেম নক্সালকে ঝেড়ে ফেলেছি জীবন থেকে। আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল , মেয়ে পোষা নাকি হেব্বি খরচের। মনে হয়েছিল দুম করে ওকে একটা ঘুষি ঝেড়ে দিই। কিন্তু রেগে যাওয়া আমাদের নিজেদের পক্ষেই ক্ষতিকর। জানি। রাগ নিয়ন্ত্রন করাই ইন্টেলিজেন্ট মানুষের লক্ষন। যাইহোক , আজ হঠাৎ ওর কথাই মনে পড়লো কেন?
রঞ্জনা ওর ফুচকার বাটি থেকে হঠাৎ একটা ফুচকা আমার মুখের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো , " দেবুদা , প্লিজ , একটা খাও। কিচ্ছু হবেনা। আমি বলছি।"
আবারো সারা শরীর জুড়ে কুলকুল করে একটা অনুভূতির ঝড় বয়ে গেল। আমি একবার ফুচকাওলার দিকে তাকালাম। লোকটা মিটমিট করে হাসছে। ওর দোকানের ভেতর থেকে আমরা কেউ পৃথিবীকে দেখার কথা ভাবিনা। হঠাৎ এ কথাটা মনে পড়লো। রঞ্জনার নরম হাত আমার মুখে ফুচকা পুরে দিলো। অতবড় হা'ই করতে পারিনি। তেতুল জল মুখ থেকে গড়িয়ে আমার জাম্পারটা ভিজিয়ে দিলো খানিক। ওরা দুজনেই শরীর ফুলিয়ে হেসে উঠলো তাতে।
আচ্ছা আশেপাশের লোককি এবার অন্তত তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে! নাহ , ব্যস্ত জলশহর নিজের গরজে মত্ত।

2 comments:

  1. আঁধার লিপি র ঘোরটা বেশ কটা দিন থাকবে মনে হচ্ছে। ব্যস্ত এই জলশহরেই আস্তে আস্তে তৈরী হচ্চে অসাধারন একটা উপন্যাস।

    ReplyDelete