চিত্রঋণ : Neeraj Parswal |
তপোভাগ ষষ্ঠ পর্ব ।
চক্ষু
ক) ত্রিনয়ন
অনির্দেশ্য
রঙের ঝাপট। বর্ণসম্ভার ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে। ফুলকি। বিস্ফোরণ। স্রোতোৎসার।
সুদীর্ঘ এক অগ্নিস্তম্ভ উঠে যাচ্ছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, ঘনকৃষ্ণ নভোতল ভেদ করে উঠে
যাচ্ছে... কোত্থেকে উঠে যাচ্ছে? উঃ কিচ্ছু
পরিষ্কার নয়... অস্তি, অস্তি, অহম্, অহম্ কি? অহম আধার। আধার অর্থে কি? আঃ কিচ্ছু
বোঝা যাচ্ছে না, এ এক প্রস্তরসম শব্দমাত্র, যা লগুড়াঘাত করছে শুধু। প্রতিপক্ষের
গদাঘাত ঝনঝনিয়ে দেয় বিশ্ব, ধরাতল কম্পিত হতে হতে অসংলগ্ন নৃত্য করে যেরূপ। নিকষ
অন্ধকারের মধ্যে অগ্নিস্তম্ভ, আঃ ঐ অগ্নিস্তম্ভে সজোরে আঘাত করলে কেমন হয়? আঘাত
করা? কে করবে? কিভাবে? অহম্, অহম্, বিন্দুমাত্র, দিকেবিদিকে আলোকবিন্দু অন্ধকার ও
অগ্নি। ন্ ন্ ন্ ন্ ন্ ন্ ন্ ধ্বনি ব্যতীত অপর কোনও শব্দ নেই। অস্তি বিন্দুবৎ...
অহম্... অস্তি অসীম, স্বাহাঃ হ্ হ্ হ্ ...
টান, ন্ ন্ ন্ ন্ ন্ ন্ ন্ ন্
খ ) দৃষ্টি
চিন্তাসূত্র
ছিন্ন হয়ে গেল অকস্মাৎ তাঁর। সর্বাঙ্গ সতর্ক, উদগ্রীব। কোন এক প্রকার শব্দ তাঁর
স্নায়ুকে জাগ্রত করেছে। এমন কোন শব্দ, যা স্বাভাবিক নয়। এখন, এই মুহূর্তে, এই
স্থানে যে শব্দের উৎপত্তিস্থল থাকবার কথা নয়। তেমন কোন শব্দ। প্রকৃতিদেবী এই সময়
নিদ্রাভিভূতা থাকেন। কিন্তু নিদ্রাভিভূত থাকলেও মনুষ্যের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ
থাকে, পাশ ফেরার শব্দ থাকে। একটি পাতা খসবার শব্দ, একটি ক্ষুদ্র প্রস্তর বিচ্যুত
হবার শব্দ, বৃক্ষশাখায় পক্ষীর পঙখতাড়নের শব্দ, পত্রান্তরালে বায়ুর মর্মর -- এসব
প্রকৃতিদেবীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। এসব নয়, অন্য কিছু, অন্য কোন শব্দ। সমস্ত
রোমকূপ জাগিয়ে উঠে দাঁড়ালেন জরাসন্ধ। তাঁর মস্তকের বামদিকে পেছনে একটি তীব্র অনুভূতি হচ্ছে।
হ্যাঁ, শব্দটি ঐদিক থেকেই। দ্রুতবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, প্রস্তূত।
-- আর্য
মৃদু এবং
স্পষ্ট স্বর। বামাস্বর। অতিপরিচিত। কপিশা।
-- এই মধ্যরাত্রে তুমি জেগে
আছো কেন?
-- নিদ্রা আসেনি আর্য।
-- খুব কি শ্রমময়ী দিবস ছিলো
আজ, কপিশে?
-- না আর্য। শ্রমে আর কি,
তাতে আমি সুখেই থাকি।
-- নিকটে এসো। উপবেশন করো
এই চত্বালে। উচ্চস্বরে কথা বলতে হচ্ছে, রাত্রির এই মধ্যযামে যা অনুচিত।
-- যথা আজ্ঞা আর্য। আপনি কেন
অনিদ্রিত আর্য? পট্টমহাদেবী সুস্থ আছেন তো?
-- ভো দুষ্ট বালিকে, মহাদেবী
সুস্থই আছেন, অন্য দেবীদেরও কূশল। কিন্তু জরাসন্ধের অনিদ্রার জন্য শুধু রাণীদেরই দেখতে
পেলে? আর কিছু নয়?
-- দাসীর অপরাধ মার্জনা করুন
দেব। আমি কৌতুহল প্রকাশ করছিলাম মাত্র। আর, পট্টমহাদেবী আমার খুব আদরের মানুষ, তাই
সংবাদ নিচ্ছিলাম। রহস্য করিনি।
-- প্রিয়ে কপিশে, এই গৃধ্রকূট,
এই গিরিব্রজ, এই মগধ রাজ্য, এই এত মনুষ্য ভূমি নদী প্রাণীসকল, এ সবের প্রহরী হয়ে জেগে
থেকেন নরপতি। তাঁকে নিদ্রা মানায়? শায়িত থাকলেও তিনি নিদ্রা যান না, সুপ্ত থাকলেও তিনি
নিদ্রা যান না। আজ তাঁকে অসুপ্ত দেখে বিস্মিত হচ্ছো? তিনি কোনদিনই নিদ্রা যান না।
-- সুপ্ত হলেও নিদ্রা যান না?
-- না। নরপতি সুপ্ত হলেও নিদ্রা
যান না। তাঁর শরীর শায়িত থাকে, বিশ্রামে থাকে। চেতনার প্রান্তরে কোথাও একটি কোন প্রহরী
জাগ্রত থাকে। প্রয়োজন বুঝলে সে আমায় জাগিয়ে দেয়। বুঝলে কি?
-- কিন্তু আর্য, দাসীর ধৃষ্টতা
মার্জনা করুন, আজ সেই প্রহরী আপনাকে সতর্ক করলো কেন? কি ঘটেছে আজ?
-- ভুল করছো কপিশে, সে আমায়
সতর্ক করে, অর্থাৎ আমার বিপদের সময় সে আমাকে জাগ্রত করে, এমন নয় সর্বদা। এমন কখনো কখনো
হতে পারে। সর্বদা নয়। কিছু ঘটেছে, ফলে আমাকে সতর্ক হতে হবে, এমন নয় কপিশে। অর্থাৎ কোন
ঘটনার জন্য নয়। কোন নির্দিষ্ট কারণ দায়ী নয়। এসো, আমার কক্ষে উপবেশন করো। দ্যাখো।...
... দ্যাখো...
...আর্য...
দ্যাখো এই
মেঘমণ্ডল, এই চরাচর। মেঘাবৃতা অমারাত্রি নয়, আবার পূর্ণচন্দ্রমার জ্যোৎস্নারাত্রিও
নয়। অথচ আজ পূর্ণচন্দ্রতিথি। এবং মেঘে আবৃত নভোমণ্ডল, অমারাত্রিও। এই দুইয়ের
কোনটিই নয় অথচ দুটিকেই অনুভব করা যাচ্ছে। এমন জ্যোৎস্নারাত বিরল, এমন বর্ষারাত্রিও
সুলভ নয়। নিদ্রাবেশ হতে দেরি হচ্ছিলো। পরে, চেতনার মুখমণ্ডল উত্তরীয়প্রান্তে ঢেকে
স্থির রয়েছিলাম। ঈষৎ পরে, অনুভব করলাম সেই ডাক। চেতনার গভীর থেকে কোন বার্তা উঠে
আসতে চাইছে উপরিতলে, যার ভাষা আমি অনেকটা জানি না। শয্যা ত্যাগ করে বাইরে এসে
দেখি, এই। আর শুতে ইচ্ছে করলো না। কিন্তু তুমি কেন অনিদ্রিত আজ, কপিশে?
-- দাসীকে তো সর্বদাই প্রস্তুত
থাকতে হয় আর্য। আমি দ্বারের বাইরে অপেক্ষায় ছিলাম।
-- কার জন্য অপেক্ষা, কপিশে?
-- আপনারই জন্য অপেক্ষা প্রভূ।
শূদ্রা দাসী জানেনা কখন সে অনুগৃহীতা হবে। অথচ যে কোনও সময় তাকে প্রয়োজন হতে পারে।
আজ আমার মনে হচ্ছিলো, আজ হয়তো আপনার প্রয়োজন হতে পারে। তাই দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছিলাম।
-- ভালোই করেছো কপিশে। আমারও
মন অশান্ত। সঙ্গিবিহীন কর্মবিহীন এই অবসরে তোমার সঙ্গই আমার প্রয়োজন ছিলো।
-- আজ্ঞা করুন আর্য।
-- আজ্ঞা? না, আদেশ আজ্ঞা
কিছু না। মন উচাটন। বিশাল এক কর্মশৃঙ্খল সন্মুখে, বারবার মনে হচ্ছে, আমি কি ঠিক করছি?
-- আপনার মন্ত্রী, আপনার বয়স্য,
আপনার সেনাপতিরা, সেনানায়করা কি বলছেন আর্য? আপনি যে পথে চলেছেন, তাতে তাঁরা সহমত তো?
-- তাদের তো আমার মতেই মত।
নরপতির এই দুর্ভাগ্য ভামিনী, তার কাছে কেউ মন খুলে কথা বলেনা।
-- তবে যে অতো অতো যুদ্ধালোচনা,
অতো অতো মন্ত্রণা, আলাপ, হাস্যপরিহাস রহস্য --
-- সে সবই রাজকার্য, সখী।
রাজ্যের সমৃদ্ধির উল্লাস। তাতে অবদান রাখতে কে না চায়? রাজ্যের নিমিত্ত নৃপ। নৃপ রাজ্যশাসনের
যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রটিকে যত্ন করা, রাজপুরুষদের অভ্যাস মাত্র। এবং সংস্কারও। তারা
তাইই করে।
-- মহাদেবীরা? তাঁরা তো আপনার
নর্মসহচরীই, রাজন্?
-- মহাদেবীরা মহাদেবীই, ভদ্রে।
তাঁরা মগধ রাজ্যের রাজ্ঞী। অন্য রাণীর তুলনায় অধিক ক্ষমতা, অধিক দাসদাসী, অধিক বৃহৎ
প্রাসাদ অথবা প্রাসাদে অধিক কক্ষ, জরাসন্ধের প্রতি অধিক অধিকার -- এসবেই তাঁরা ন্যস্ত।
রাজকার্যেই তাঁদের আগ্রহ নেই, জরাসন্ধের স্বপ্ন তাঁরা কি বুঝবেন?
-- কুমার?
-- কুমারেরা কতোই বা বড়ো কপিশে?
জ্যেষ্ঠ কুমার নবম বর্ষ, কনিষ্ঠটি সবেমাত্র সপ্তমবর্ষের। তাঁদের সে বয়স বা প্রজ্ঞা
হয়নি যে তাঁরা জরাসন্ধের স্বপ্ন ধারণ করতে পারে।
-- কেউই নেই আর্য? মহামতি
ডিম্বক, মহামতি হংসদেব?
-- ডিম্বক ও হংস দুই অসাধারণ
বীর। তাঁরা আমার অনুগতও। তাদের যা বলি, তাতেই তাঁরা রাজি। নিজের মস্তক ঘর্মাক্ত করার
প্রচেষ্টা তাঁরা করেনা। তাঁদের আদেশ দাও, তারা তার শেষবিন্দুটি অব্দি পালন করবে।
-- কিন্তু রাজ্যে তো তেমন বড়ো কোন সমস্যা নেই আর্য।
যেটুকু আছে, তা স্বাভাবিকই। আপনার চিন্তায় তাহলে কোন কীট এমন দংশন করছে আর্য, যা আপনি
কারো কাছেই বলতে পারছেন না?
-- চিন্তাকীট? ভালো বলেছো
কপিশে। না, সমস্যা নয়। আমার রাজ্য এই আর্যাবর্তের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ রাজ্য। কিন্তু
রাজ্য নয়। আমি চাই সাম্রাজ্য।
-- সাম্রাজ্য?
-- সাম্রাজ্য। এই সসাগরা পৃথ্বীকে
আমি মগধরাজ্যের অধীনে আনতে চাই। আর্যাবর্তের সমস্ত ভূমি জরাসন্ধের আশীর্বাদহস্তের নিচে
থাকবে।
-- রাজসূয় যজ্ঞ, প্রভূ?
-- না। ওই প্রথা প্রাচীন হয়ে
গেছে, উত্তরাপথের মূর্খ নৃপেরা তা বোঝে না। ওভাবে কর লাভ হতে পারে, সাময়িক রাজ্য লাভও
হতে পারে, সাম্রাজ্যবিস্তার হয়না।
-- সাময়িক রাজ্যলাভ?
-- হ্যাঁ। যে নৃপতি কর দিয়ে
আপন রাজ্যে ফিরে গেল, সে আপন রাজ্যে প্রধান পুরুষ হয়েই রইলো। সম্রাটকে সে গ্রাহ্য না
করতেই পারে। আবার যুদ্ধযাত্রা করতে হতে পারে তাঁর জন্য। এই পদ্ধতিটাই পুরোনো, অচল।
-- তাহলে উপায়, প্রভূ?
-- উপায় সবথেকে সহজ। কেউ ভাবেনি
এর আগে। বন্দীশালা।
-- বন্দীশালা?
-- হ্যাঁ। ধরো আমি কোন রাজ্য
জয় করলাম। সেখানকার নরপতিকে আমার কারাগারে বন্দী রাখলাম এবং তাঁরই পুত্রকে সেখানের
সামন্ত বলে প্রতিষ্ঠা করলাম। এরপর সেই পুত্র তাঁর পিতার ছিন্নমুণ্ড যদি না দেখতে চায়
তো সে আমার অধীন থাকবে আজীবন। এভাবে একের পর এক রাজ্য, তার নৃপেরা আমার কাছে বন্দী,
তাদের পুত্রেরা আমার অধীনে সামন্ত --
-- কিন্তু দেব, যদি কোন পুত্র
পিতার মৃত্যু গ্রাহ্য না করে বিদ্রোহ করে?
-- পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম
এই আর্যাবর্তে, কপিশে। পিতা ঈশ্বরের চেয়েও বড়ো। এ দেশ অন্ধ অনুগত পিতৃভক্তির। তবুও
যদি এক আধজন এমন বিদ্রোহী হয়, তাকে দমন করা যাবে।
-- দক্ষিণ পর্বতের নিচে যে
কারাগার নির্মিত হচ্ছে, তা কি এই বন্দী নৃপদের জন্য, মহারাজ?
-- হ্যাঁ। এখনো অব্দি ছয়জন
নৃপতি বন্দী হয়েছেন। আমার প্রাসাদেই আছেন তাঁরা। এবার তো সংখ্যাটা বাড়বে, আর্যাবর্তে
কতো কতো রাজ্য। তাই একটি সঠিক রাজকারাগার নির্মাণ করতে হচ্ছে...
-- কিন্তু মহারাজ, কোন বন্দী
নরপতি যদি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন? তখন তার পুত্র যদি আপন রাজ্যে বিদ্রোহ করেন? স্বাতন্ত্র্য
ঘোষণা করেন?
-- সেকথাও কি আর ভাবিনি? বন্দী
নৃপের বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর পুত্রকে পিতৃসন্দর্শণের জন্য ডেকে এনে বন্দী
করা হবে। যদি আসতে না চায়, সৈন্য পাঠিয়ে আনতে
হবে। তারপর সেই পুত্রকে বন্দী করে পিতাকে মুক্তি দেওয়া হবে। তিনি রাজ্যে ফিরে পৌত্রকে
রাজপদে অভিষিক্ত করবেন।
পূর্বদিক থেকে
ধরেছি। সবথেকে কঠিন দুইটি বাধা হলো এই ভরতবংশ এবং যাদবকূল। ভরতবংশ পরম্পরাগতভাবে
বীর। যাদবকূল এমনিতে বহুধাবিভক্ত কিন্তু বিপদের সময় একত্র হয়ে যায়। একে একে উৎপাটন
করতে হবে এই দুইটি কন্টক। তারও আগে, পাঞ্চাল।
-- পাঞ্চাল, প্রভূ? কিন্তু
আপনি বললেন ভরতবংশ এবং যাদবকূল -
-- হ্যাঁ, বলেছি। পাঞ্চালরাজ্য
এদের মতো কঠিন প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু এই কঠিন প্রতিপক্ষদের মুখোমুখি হবার জন্য আগে পাঞ্চালরাজ্যকে
মগধের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
-- কিভাবে, প্রভূ?
-- দ্যাখো, এই পাঞ্চাল দেশটি
গঙ্গার দক্ষিণে ও উত্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। পূর্বে গোমতী থেকে পশ্চিমে চর্মন্বতী নদী অব্দি
এর সীমা। এই পাঞ্চালরা ক্রৈব্য, ক্রৈব্যদের বীরত্বের খ্যাতি ছিলো, আগে কৃবিদেশে তাদের
বাস ছিলো --
-- কৃবিদেশ কোথায়, দেব?
-- আরো উত্তর পশ্চিম প্রান্তে,
সিন্ধু এবং অসিক্লী নদীর পাড়ে। পরে অজমীঢ় রাজের বংশের বাহ্যাশ্ব নামক নৃপতির পাঁচ বীর
পুত্র গঙ্গানদীর উত্তরে ও দক্ষিণে পাঁচটি রাজ্য জয় করেন। এই পাঁচ রাজ্যই বর্তমানে একত্রে
পাঞ্চাল। পরমবীর দ্রুপদ সে রাজ্যের শীর্ষে। হস্তিনাপুর আক্রমণের আগে এই পাঞ্চালরাজ্য
জয় করতে হবে কপিশে।
-- কেন দেব, হস্তিনাপুর আক্রমণের
আগে পাঞ্চালরাজ্য জয় করতে হবে কেন?
-- কপিশে, পাঞ্চাল অতি সমৃদ্ধ
রাজ্য, কিন্তু সে রাজ্যের প্রভূ দ্রুপদ সন্তানহীন। ফলে, তাঁর বীর্যে তাঁর প্রজারও সংশয়
রয়েছে, তাঁর নিজেরও। রাজপুত্রেরা খেলে না বেড়ালে রাজপুরী শ্মশানতুল্য। রাজপুত্রদের
দুর্দান্তপনা করতে দেখলে প্রজারা নিশ্চিত হয়, যে, এই প্রাণশক্তিই প্রজার বিপদের সময়
সন্মুখে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। অপুত্রক নৃপের শিরে প্রজার অভিশাপ বর্ষিত হয়। এই সব নিয়ে
পাঞ্চালরাজ্যের শীর্ষবন্দুটি দুর্বল হয়ে আছে, তাকে স্থানচ্যুত করা সম্ভব।
এরপর, ধরো গঙ্গার দুই কূল
ব্যেপে এই যে পাঞ্চালরাজ্য, সেদিক থেকে পাঞ্চালী সেনা, এবং দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে মাগধ
সেনা, এই দ্বিমুখী আক্রমণ হস্তিনাপুর রাজ্য জয়ের প্রাথমিক শর্ত। তারপর আমার বাহুবল
তো রইলোই।
-- আর্য, আমি এত কিছু ধারণ
করতে পারছি না। আপনি সারাক্ষণ এই সব ভাবেন? সর্বদা যুদ্ধ, রাজ্যজয় -- এইসব?
-- কপিশে, ভাবো, একটি বৃক
তোমায় আক্রমণ করেছে। তুমি দশটি কঙ্কর দিয়ে তাকে উপর্যুপরি প্রহার করো, তাতে তার কিছু
হবেনা। কিন্তু সেই দশটি কঙ্কর একত্র করে একটি লোষ্ট্র বানিয়ে তাকে প্রহার করো, সে সামান্য
হলেও আহত হবে, থমকে যাবে, তোমায় আক্রমণ করবেনা। এবার, দশটির স্থানে একশত কঙ্কর নিয়ে লোষ্ট্র বানাও, তার আঘাতে তুমি
বৃকটিকে হত্যাও করতে পারবে।
ক্ষুদ্রে সুখ নেই, ক্ষুদ্রে শক্তি নেই। একটি কেন্দ্রীয়
শাসনের অধীনে আসা প্রয়োজন সমগ্র আর্যাবর্ত, একথা আর্যাবর্তের নৃপেরা কখনোই বুঝবেনা।
তাই আমাকেই সে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।
-- আমি তো ধারণাই করতে পারছি
না। দেব, এ আপনার পরিকল্পনা --
-- সময় অনেক লাগবে সুন্দরী।
হয়তো সারাজীবন। হয়তো অর্ধেক সম্পন্ন করতে পারবো, আমার পরবর্তীরা বাকিটা এগিয়ে নিয়ে
যাবে। দেখা যাক। আমার প্রভূ উমাপতি শঙ্কর, তাঁর আশীর্বাদে সব অসম্ভবও সম্ভব হয়--
........
-- প্রভূ, পূর্ব গগনে ঊষাদেবীর
কমলচরণের অলক্তকরাগ দেখা যাচ্ছে। গাত্রোত্থান করুন।
-- হ্যাঁ, দেবদিবাকর পৃথ্বীঅবলোকনের আগেই আমি দেবদেব
পশুপতিকে মস্তকে ধারণ করে নিই। কপিশে, পূজার ব্যবস্থা করো, আমি স্নান করে আসি।
গ ) ধ্যান
মহাদেব।
দেবতাদের দেবতা, আদিদেব। এ ভূমি তাঁরই। এ ভূমির তিনিই একমাত্র ঈশ্বর। এ ভূমির
সর্বত্র তাঁকে অনুভব করা যায়, তাঁর চিহ্ন দেখা যায়। কতো যুগ আগে থেকে, যেন বা
কল্পান্তপূর্ব থেকে তাঁর ছাপ রয়েছে এই ভূমিতে। ইদানীং অবশ্য অনেককেই দেবতা বলে
মান্য করে লোকজন, অনেক নতুন নতুন দেবতা উদ্ভিন্ন হচ্ছেন প্রত্যহ, বীরগাথার নায়কদের
স্তূতি করতে করতে কখন যে স্তব করতে শুরু করে মানুষ, তারপর সেই বীর দেবতা হয়ে যায়।
হেঃ দেবতা! দেবতা তো অনেকেই হচ্ছে, হয়, ঈশ্বর একজনই। দেবতাদের দেবতা। দেবদেব,
মহাদেব। ওই হলো সত্তা। আহা, অমন সত্তা আর কার আছে?
তাঁর উপাসনা না করলে দিন শুরু হয় না। ব্রাহ্মমুহূর্তে,
পূর্বদিকে মুখ করে তিনি বসেন। রাত্রির স্নেহ জড়িয়ে আছে বাতাসকে তখনো, জরাসন্ধ তাঁর
প্রভু মহাদেবকে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর সমস্তই অর্পণ করেন প্রভুকে। স্পর্শ করেন তাঁকে।
তারপর দীর্ঘ সময় ধ্যানে অবস্থান করেন জরাসন্ধ, ধারণ করেন আপন ঈশ্বরকে। তাঁর দিন শুরু
হয়ে যায়।
লেখক তিনটি পর্ব শুনিয়েছিলেন , আজ ষষ্ঠ পর্ব । একটু অসুবিধা হল । এরপর অসুবিধা হবে না নিশ্চয় ।
ReplyDeleteপাঠের পরে এক আশ্চর্য ঘোরে থাকি।গদ্যমহিমা আচ্ছন্ন করে ফেলে। মন্তব্য মতামত অনাবশ্যক।
ReplyDeleteশুরুর দিকে ধারাবাহিক গল্প হিসাবে চিহ্নিত ছিল।পরে ধারাবাহিক উপন্যাস। সেসব সংজ্ঞা নিরূপনে ব্যস্ত থাকলে পাঠ আহ্লাদ নষ্ট হয়।
সুপ্রিয়কে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বাক পত্রিকা পরিচালকদের।