। বাক্ ১২৫ ।। আমার সফর দূর্বাদল মজুমদার ।।















(একটা কথা না বললেই নয়,এই লেখা আমার মনমর্জি বর্ণনা। যখন যা মনে পড়বে তাই লিখে যাব। চরিত্র এবং স্থানগুলি,গ্রামের নাম, বিশেষ কারণে আমাকে বদলাতে হতে পারে।বিশেষত গ্রামের গরীব মানুষগুলোর কথা ভেবে।যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন।কেউ কেউ জেলে।আর ঘরছাড়া গ্রাম বা শহরের ক্যাডাররা তো ছদ্মনামেই ঘুরে বেড়িয়েছে , তাই তাদের নাম যা ইচ্ছে রাখা যেতেই পারে।)  



#       

ভালুকের কথায় মনে পড়ল.... বাংরিঘাটির দুয়ারসিনির পুরোহিত চন্দ্রকান্ত পাঁড়েজির  অদ্ভুত ক্ষমতার।প্রতিদিনই এক ভালুক মা এবং তার বাচ্চারা তাঁর হাত থেকে প্রসাদ খেতে আসত।দৈনিক পুজো শেষ হলেই ওরা পাহাড় থেকে একেবারে রাস্তায় মন্দিরের চাতালে নেমে আসত।পথচলতি ট্রাকড্রাইভাররা কলাটা-মূলোটা দিয়ে যেত পাঁড়েজিকে।ভালুকের প্রসাদ। কিভাবে যে পাঁড়েজি তাকে বশ করেছিল এখনোও ভেবে চমক লাগে।তখন তার বয়সও ছিল কম। বোধয় চল্লিশ বিয়াল্ললিশ হবে।এখন বেঁচে আছে কি না। হয়ত কেউ  ভালুক খাওয়ানোর দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দি করেছিল।এই সেদিন ইউটিউবে দেখলাম ভিডিওটা।তখন তো আর এত মোবাইলের রমরমা ছিলনা।তবে পথচলতি কোনো ক্যামেরাধারী ঘটনাটা ধরে থাকতে পারে।    

জঙ্গলের পশুর প্রতি অগাধ মমতা ছিল পাঁড়েজির।মন্দির চত্বরে অসংখ্য বাঁদর ছিল।রাতবিরেতে বেড়াতে আসত সজারু,চিতা,প্যাঙ্গোলিন।
মাঝেমধ্যে তাঁর আশ্রমে থেকেওছি সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে।তবে একটা ঘটনার পর ওখানে পুলিশ হানা দেয়,আর আমাদের মন্দিরমুখো হতে হয়নি। 

মাওয়িস্টদের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। যদিও তখনো মাওয়িস্ট শব্দটা ভারতের সংবাদপত্রের শব্দ হয়ে ওঠে নি  ।আর বাংলা কাগজগুলোর নকশাল সম্পর্কে জ্ঞানের দৌড় ছিল ৭১ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত। তখন তিনটি মাত্র মাওপন্থী দল সশস্ত্র অনুশীলন করছিল।সি পি আই এম এল(পিপলস ওয়ার),এম সি সি এবং সি পি আই এমএল (পার্টি ইউনিটি)।আরো অনেক দল উপদল ছিল,কিন্তু তারা ছিল কাগুজে পার্টি।প্র্যাকটিসের মধ্যে ছিল না।
এদের মধ্যে শুধু আদর্শগত সংঘাত ছিল তাই নয়,কোথাও কোথাও সরাসরি নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত এরা।         

এই সংঘর্ষের ঘটনাগুলো বেশি ঘটত তদস্থ বিহার রাজ্যে।তখনো ঝাড়খন্ড গঠিত হয়নি। শিবু সোরেন তখন দক্ষিণ বিহারের মসিহা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর  তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন,ঝাড়খন্ড গঠিত হলে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। এদিকে লালুপ্রসাদ বুঝতে পারছিলেন বিহার ভাঙবে।অতয়েব ট্রেজারির টাকাগুলো যেনতেন উপায়ে তুলে নিতে হবে।এই ধরণের রাজনৈতিক নেতারা এতকাল ধরে একটা রাজ্যে প্রাসঙ্গিক থাকে কীভাবে সেটা নিয়ে থিসিস লেখা যায়।  

ছিলাম ওড়িশায়,কথা বলছি ঝাড়খন্ডের।এর কারন হল মাওয়িস্টদের কৌশলটাই ছিল জেলা এবং রাজ্যের মিশেল অঞ্চলে ঘাঁটি গড়ে তোলা।একরাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাতে সহজেই চলে যাওয়া যায় এবং পুলিশ প্রসাসন তাদের টেরিটোরিয়্যাল ডিসঅর্ডারের মধ্যে পড়ে যায়,এই ছিল সুবিধা। কে না জানে যে ইন্টারডিস্ট্রিক্ট এবং ইন্টারস্টেট পুলিশের মধ্যে রাজনৈতিক অসামঞ্জস্যর কথা।মাওবাদিরা এর ফায়দা তোলার জন্য বেছে নিত এইসব অঞ্চল।আমি যে এলাকার কথা লিখছি এটা ছিল সেইরকমের এক অঞ্চল।যার একদিকে ওড়িশা অন্যপাশে ঝাড়খন্ড।আর তার করিডোর ধরে ডুমারিয়া যাদুগোড়া চাকুলিয়া হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বেলপাহাড়িতে সহজেই আসা যায়।তাই মাওয়িস্ট অ্যাকটিভিস্টদের লাগোয়া সবরাজ্যের রাজনৈতিক খবরাখবর রাখতে হত। বেলপাহাড়ি থেকে ঘাটশিলা ডুমারিয়া হয়ে বাংরিপোসি বা সিমলিপাল ফরেস্টরেঞ্জ হয়ে চাইবাসার বেতলা ন্যাশনাল পার্ক এটা একটা সুদূরপ্রসারী করিডোর।  তখন ঝাড়খন্ডের পুরোটাই ছিল নকশাল অধ্যুষিত।

যাইহোক আমার বাংরিপোসি সফরকালে সারাদিন চলার পর বিকেলনাগাদ আমরা পৌঁছলাম একটা উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়।এখানে ক্যাম্প হবে।কিছুটা সমতল জায়গা বেছে নিয়ে বড় বড় পাথরের আড়ালে আমরা জিনিসপত্র রেখে জলের সন্ধানে বেরোলাম।  কেউ রান্নার আয়োজনে রইল। এখানে পাহাড়ি ঝোরার অভাব নেই।ক্যাম্প বলতে রাতের সাময়িক আস্তানা। রাতের বেলায় বন্য জন্তুরা পাহাড় থেকে নীচের বনতলীতে নেমে যায়,বসতির কাছাকাছি। 
  আমাদের দলটা ভারি ছিল।প্রায় চল্লিশজন।পনের দিনের একটা ট্রেনিং এর শেষে পার্টির রিজিওনাল সম্মেলন হবে তারপর আবার নিজস্ব এলাকায় ফিরে যাওয়া।আমরা ছিলাম তখনকার সি পি আই এমএল(পিপলস ওয়ার)এর সদস্য।যার মাথায় ছিলেন কমরেড গনপতি।তিনি ছিলেন অন্ধ্রের লোক।তার মাথার দাম পঞ্চাশ  কোটি টাকা।তাকে দেখিনি কখনো। 
প্রায় সারাদিন হাঁটার পর আমরা ক্লান্ত।এখানে পাহাড়ের চূড়ায় বসে শেষ বিকেলের আলোয় চারপাশের দিকে তাকাতে সব ক্লান্তি উধাও।সেপ্টেম্বরের নরম  আলোয় হলদেসবুজ জঙ্গলে  ঢাকা পাহাড়ের  সারির পর সারি চলে গেছে দিগন্তের দিকে।এ দেখা অন্যরকম দেখা।নিরাপদে সমস্ত আরামের মধ্যে থেকে ট্যুরিস্টের দেখা নয়।ছবিতে বা ইউটউবের ভিডিও দেখা নয়,।নিঃসীম হয়েওঠা প্রকৃতির মধ্যে থেকে লড়াই করে তাকে পরাস্ত করে তার এতকাল লুকিয়েরাখা গহন  বুকের ভেতর থেকে দেখা।হেরে গিয়ে লজ্জা পেয়ে বা বিড়ম্বনায় পড়ে নয়,হেরে গিয়ে জয়ীর দিকে সাবাসীর হাত বাড়িয়েই  সহাস্য হয়ে সে নারী তার শরীরের মহিম খুলে স্বাগত জানিয়েছে আমাকে।প্রকৃতির এই  মনোরমণের বর্ণনাভাষ্য আমার কাছে নেই।তখন তো ছিলই না।সে যুবক যুগপৎ নির্বাক ও দৃশ্যাহত।তার মনশরীরের থেকে ঝরে যাচ্ছে অনিঃশেষ অর্গাজম। 
    ও-ও-ই দূরে দেখতে পাচ্ছ,আলো জ্বলছে,ওটা ধলাইপোসির ড্যামের আলো।আর হু ই ই- সোজা উত্তরে আর একটু পরে লাল আলোর আভা ফুটে উঠবে,উটা বাদামপাহাড়ের লোহা মাইনসের আলো।ইখেন থেই দ্যাখা যায়।তবে অনক দূর বঠে।বলেছিল কানুদা।উনি এখানকারই লোক।তবে বাংলাটা ভালোই বলেন।পরে জেনেছিলাম ওড়িশার কেওনঝড় ও ময়ুরভঞ্জ জেলার অনেক মানুষ ভালো বাংলা বলতে পারে।তবে তাতে মিশে থাকে বহু লোকাল ডায়ালেক্ট।ফলে সে বাংলা বুঝতে গেলে রীতিমতো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।এ দলের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে ছোটখাটো ও দূর্বল মানুষ।কিষানজি আমার আসল নাম জানতেন,তাই ঠাট্টা করে আমার নাম রেখেছিলেন "দুর্বল"। এ নিয়ে  দলের মধ্যে আমাকে বহু খোঁচা হজম করতে হতো।আর সমস্ত দিক থেকে দূর্বল থাকার ফলে গ্রামের মানুষজনের কাছ থেকে বহু সাহায্য ও সাহচর্য পেয়েছি।কানুদাও আমাকে সাহায্য করার জন্য কাছেপিঠেই থাকত।দলের দূর্বল মানুষটির প্রতি সবলদের স্বাভাবিক করুণা। কানুদার মতো শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।অপার দয়ালু ও সাহসী এই দ্বিগুনের মিশ্রণ আমি কম মানুষের মধ্যে দেখেছি।কখনো স্কুলের মুখ দেখেন নি অথচ অগাধ জ্ঞানের  ভাণ্ডার।বাংলা হিন্দি ওড়িয়া আর ওর মাতৃভাষা সাঁওতালি,চারভাষাতেই কথা বলতে পারতেন।উপস্থিত বুদ্ধি ও পরিস্থিতির নিখুঁত বিচারক( 30 06 Sniper রাইফেলের মতো)  যার ওপর " চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়"।এই ছিল কানুদা। 

                                                    (ক্রমশঃ) 

               




No comments:

Post a Comment